করোনা রোগী শনাক্তে নারায়ণগঞ্জে ল্যাব ও পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) মেশিন স্থাপন না করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুই ধরনের কথা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং স্বাস্থ্য সচিব মো. আসাদুল ইসলাম। যদিও এসময় তারা দু’জন পাশাপাশি বসা ছিলেন।
স্বাস্থ্য সচিব বলেন, আমাদের পিসিআর মেশিন আছে। তবে নারায়ণগঞ্জে কোনো ল্যাব না থাকায় সেখানে স্থাপন করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশে তো পিসিআর মেশিন অ্যাভেইলঅ্যাবল না। যদি থাকতো তাহলে আমরা এতদিনে বসিয়ে ফেলতাম।
বৃহস্পতিবার (১৬ এপ্রিল) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ঢাকা বিভাগের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ ভিডিও কনফারেন্সে সূচনা বক্তব্যের পর নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।
ভিডিও কনফারেন্সে নারায়গঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সেলিম রেজা প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। সেখানে আমাদের মনে হয় এই টেস্ট যত করা যাবে, পরীক্ষা করে আইসোলেশন করে রাখলে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যাবে।
তিনি বলেন, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে প্রতিদিন দেড়’শ মতো স্যাম্পল টেস্ট করা যাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিতে এটা আরো বাড়াতে পারলে বা নারায়ণগঞ্জে ল্যাব স্থাপন করতে পারলে ভালো হয়।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু। তিনি বলেন, শনাক্তকরণের বিষয়টা গতি আরও বাড়ালে ভালো হয়। প্রত্যেক উপজেলায় যেহেতু ছড়িয়ে পড়িছে, আমরা যথাযথ চেষ্টা করছি, বাকিটুকু আল্লাহর ইচ্ছে।’
এরপর কথা বলেন জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন, খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. শামসুদ্দোহা সরকার।
ডা. মো. শামসুদ্দোহা সরকার বলেন, যেহেতু নারায়ণগঞ্জে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, এটা শিল্পনগরী এবং বন্দরনগরী। প্রচুর বিদেশফেরত লোক নারায়ণগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যাদের ট্রেস আমাদের হাতে পুরোপুরি নেই। আমাদের একটা দাবি এখানে একটা পূর্ণাঙ্গ পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা। যেহেতু এখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় একটা ৩০০ বেডের হাসপাতালও আছে।
তিনি বলেন, আমাদের স্যাম্পলগুলো কালেকশন করে ঢাকায় পাঠাতে হয়। রিপোর্ট পেতে অনেক সময় দু’দিন সময় লেগে যায়। সেখানে আলাদা পিসিআর ল্যাব থাকলে সকালে স্যাম্পল দিয়ে সন্ধ্যায় রিপোর্ট পেয়ে যাবো। এই ট্রানজিশন পিরিয়ড কমিয়ে একদিনে আনতে পারলে দ্রুত রোগী শনাক্ত করতে পারবো। দরকার হলে আইসোলেশনে এবং কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে পারবো। – আমাদের দাবি আপনি নির্দেশনা দেবেন যেন অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে একটা পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের এই সমস্যার বিষয়টি নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা এইমাত্র শুনলেন নারায়ণগঞ্জের সমস্যা। আমাদের ঢাকার পর নারায়গঞ্জে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। সেখানে তাদের যে সমস্যা- একটা হলো ল্যাব নেই তাদের। ঢাকায় টেস্ট করতে হয়। দ্বিতীয় হলো মাস্ক যেটা এটা আসলে আমাদের নাই, এটা কী সমাধান আছে সেটা বলেন।
স্বাস্থ্য সচিব মো. আসাদুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ল্যাবের বিষয়টি আমরা এখনও চেষ্টা করছি, ওখানে ল্যাব সেট-আপ করা যায় কিনা। আগে ল্যাব সেট-আপ করে তারপর পিসিআর মেশিন আমরা দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। পিসিআর মেশিন আমাদের আছে, কিন্তু, ল্যাব নেই।
‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম যে আমাদের মাতুয়াইলে শিশু স্বাস্থ্য ওখানে ল্যাব ব্যবহার করা যায় কিনা। কিন্তু সেটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে আমরা আগে ল্যাব সেট-আপ করে পরে পিসিআর মেশিন সেখানে বসাতে হবে। সেটা একটু সময় লাগবে। যদি আমাদের আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়ে সেটা আমরা করবো।
এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নারায়ণগঞ্জে কি কোনো ইন্সটিটিউশন নাই? কিচ্ছু নাই যে যেখানে একটা ল্যাব স্থাপন করা যায়? আচ্ছা যে কোনো একটা রিসার্চ সেন্টার লাগবে। কিন্তু, আমি খুব অবাক হচ্ছি যে নারায়ণগঞ্জে কী কোথাও কোনোও রিসার্চ সেন্টার নাই? তার মানে নারায়ণগঞ্জ সারা জীবন ঢাকার ওপর নির্ভর করে চলে আসছে।
এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ওখানে সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীর উনিও চেষ্টা করছেন একটা ল্যাবরেটরি বানাতে। কিন্তু আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে যখন এই প্রয়োজনটার কথা জানতে পেরেছিলাম- আমরা খুবই চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব ওখানে একটা পিসিআর মেশিন বসানো যায় কিনা। সবচেয়ে অসুবিধাটা হলো বাংলাদেশে তো পিসিআর মেশিন অ্যাভেইলঅ্যাবল না। যদি থাকতো তাহলে আমরা এতদিনে বসিয়ে ফেলতাম। আমরা যতদ্রুত সম্ভব সেটা বসানোর চেষ্টা করবো।
ডিজি আরও বলেন, ওখানে যেটা করা হয় সারা দিনের স্যাম্পল কালেকশন করে তারপর আমাদের কাছে নিয়ে আসে। কখনো কখনো সারারাত লেগে যায়। ওখানে দিনের মধ্যে যদি কয়েকবার স্যাম্পল আনা যায় আমরা সেই প্রচেষ্টাটা গ্রহণ করবো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঠিক আছে এক কাজ করেন। ওখানে যতদ্রুত পরীক্ষাটা করা যায় অন্তত সেই ব্যবস্থাটা আপনারা নেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে এখন তো আসা যাওয়া খুব কাছে হয়ে গেছে। যত দ্রুত এসে এটা করা যায়। দরকার হলে এখানে ঢাকায় আপনারা একটা ডেডিকেটেড উইং করে দেন। কিছু লোককে দায়িত্ব দিয়ে দেন যে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসার সঙ্গে সঙ্গে এটা করে দেবে। জোন হিসেবে ভাগ করে দিলে দ্রুত হয়ে যায়।
এন-৯৫ মাস্ক ছাড়া সুরক্ষা সামগ্রী পেয়েছেন জানিয়ে বলেন জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন, খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. শামসুদ্দোহা সরকার বলেন, ‘সুরক্ষা সামগ্রী আমরা পেয়েছি। তবে সারা পৃথিবীর মতো আমাদের এখানেও এন-৯৫ মাস্কের সংকট। যেটি করোনা পজিটিভ রোগীর চিকিৎসায় অত্যন্ত দরকার। এন-৯৫ মাস্ক আমার হাসপাতালে একটাও পাইনি।’
‘তবে করোনা চিকিৎসায় থেমে থাকিনি। মাস্ক ছাড়াই কিন্তু খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতাল করোনা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি না সে কারণেই কিনা আমার হাসপাতালে ১৬ জন চিকিৎসক কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার নির্দেশনায় আমরা মহামারি যুদ্ধে পিছিয়ে থাকবো না।’
মাস্ক বিষয়ে স্বাস্থ্য সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, মাস্কের বিষয়টি এন-৯৫ মাস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এগুলোর এখন কোনো সরবরাহ নেই। তবে এন-৯৫ এর সমমানের যেসব মাস্ক আছে সেগুলো আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এন-৯৫ যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড, চায়না ব্র্যান্ড হলো কেএন-৯৫। এছাড়া জাপানিজ ব্র্যান্ড রয়েছে।…’
যুক্তরাষ্ট্রের এন-৯৫ মাস্কের সমমানের মাস্ক বাংলাদেশের আছে কিনা জানতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন সচিব বলে সেটা আমাদের আছে। এই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের আরও অ্যাভেইলঅ্যাভল হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারায়ণগঞ্জে সেটা (সমমানের মাস্ক) দেওয়া হয়নি?
স্বাস্থ্য সচিব বলেন, দেওয়া হয়েছে তবে প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের সব জায়গায় স্বল্পতা রয়েছে। কিছু দেওয়া হয়েছে আরও দিয়ে দেওয়া হবে। আমরা যেভাবে সংগ্রহ করছি সেভাবে বিতরণ করছি।