করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটে পড়া সারাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করছে সরকার। পর্যায়ক্রমে ৫ কোটি দরিদ্রকে এই ডাটাবেজের আওতায় আনা হবে। এর পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ওই ডাটাবেজ প্রকাশ করা হবে। তালিকা অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে সবাইকে একযোগে দেওয়া হবে সরকারের ত্রাণ সহায়তা। দেশে যতদিন করোনা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এই সহায়তা প্রদান করবে সরকার। আজ সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ডাটাবেজ তৈরি কার্যক্রম। তবে ধনী-গরিবের তালিকা করার জন্য সরকার এর আগে বহুবার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করার পরও চূড়ান্ত কোনো তালিকা তৈরি করতে পারেনি। দেশের সবচেয়ে সংকটকালে গরিবের এই তালিকা স্বচ্ছতার সঙ্গে কতটুকু করা সম্ভব হবে, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
জানা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মাধ্যমে সারাদেশের প্রত্যেক ওয়ার্ডে তৈরি করা হবে দরিদ্রদের তালিকা। এর পর প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে দরিদ্রদের নাম নিয়ে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে (ইউডিসি) ডাটাবেজ করা হবে। সেই তালিকা সংশ্নিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠানো হবে। প্রত্যেক ইউএনও স্ব স্ব জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে পাঠাবেন দরিদ্রদের ওই তালিকা। এর পর জেলা প্রশাসক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ পর্যায়ক্রমে সারাদেশের দরিদ্র মানুষের তালিকা কেন্দ্রীয়ভাবে ডাটাবেজ করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এটি সংরক্ষণ করবে। যাতে কেউ তালিকা পরিবর্তন করতে না পারে, একই ব্যক্তি একাধিকবার ত্রাণ না পায়, এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করা হবে কেন্দ্রীয়ভাবে। কোনো অভিযোগ থাকলে সেটাও অনলাইনে গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া এই তালিকায় কোনো অনিয়ম হলে সরাসরি অভিযোগ করা যাবে ৩৩৩ নম্বরে কল করে। এ জন্য এখন থেকে ৩৩৩ নম্বরের সংযোগ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘আগে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্রের তালিকাভুক্ত ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেটি বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে সারাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট ৫ কোটি। এদের সবাইকে ডিজিটাল ডাটাবেজের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজ থেকে সেই ডাটাবেজের কাজ শুরু হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ৫ কোটি দরিদ্র মানুষকে ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যতদিন করোনা পরিস্থিতি চলবে ততদিন প্রতি সপ্তাহে সবাইকে একযোগে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ত্রাণ কার্যক্রমে যেন কোনো ধরনের অনিয়ম না হয় এ জন্য ৩৩৩ নম্বরের সংযোগ এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে যুক্ত করা হয়েছে। ত্রাণের জন্য যে কেউ মন্ত্রণালয়ে কল করতে পারবেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম সমকালকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকা দরিদ্রভুক্ত সব মানুষকে ডাটাবেজে আনা সরকারের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। করোনা পরিস্থিতিতে ঠেকায় পড়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেই তালিকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এর অনেক কাজ শুরু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, দ্রুত কাজ করার জন্য এক্সেল পদ্ধতিতে এ তালিকা করা হচ্ছে। কারণ, ডাটাবেজ আলাদা করা হলে অনেক সময় লেগে যাবে। এখন খুব কম সময়ের মধ্যে কাজ করা যাবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এটি সংরক্ষণ করবে। পরিস্থিতি ভালো হলে পরবর্তী সময়েও এটি সরকারের অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হবে। ঢাকা বিভাগ থেকে এর কাজ শুরু হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ছয় বছর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় খানা জরিপ (এনএইচডি) প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি তালিকা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। জরিপের কাজও শেষ। কিন্তু তালিকাটি এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ওই তালিকা হলে দুর্যোগের এই সময়ে ত্রাণ বিতরণ খুবই সহজ হতো। বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের ১৪৫টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র শ্রেণির বদলে সচ্ছলদের ভাতা পাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মতে, ত্রাণ দেওয়ার সময় অনিয়মের প্রধান কারণ হলো দেশে ধনী ও দরিদ্রের কোনো তালিকা না থাকা। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকা ও ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনতে ২০১৩ সালে প্রতিটি থানা থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজে হাত দেয় পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় খানা ডাটাবেজ জরিপ (এনএইচডি) চালিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো একটি ধনী-দরিদ্রের তালিকা তৈরি করা। ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে তিন কোটি খানার তথ্য সংগ্রহ করার প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি শেষ করতে পারেনি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। দুই দফা বাড়িয়ে এখন প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আর ৩২৮ কোটি টাকার প্রকল্প গিয়ে ৭২৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে। এ বিষয়ে বিবিএসের মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পটির কাজ এখনও শেষ হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘দুর্যোগের এই সময়ে এটি অনেক ভালো উদ্যোগ। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যাচাই-বাছাই করে স্বচ্ছ তালিকা করা অনেক কঠিন। এ জন্য সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তালিকা যেন বস্তুনিষ্ঠ হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ, এই দুর্যোগ সবার জন্য।’ তিনি বলেন, দরিদ্রদের জন্য এই তালিকা করা হলে নিয়মিত এটি হালনাগাদ করতে হবে। তা যেন রাজনৈতিক বা দলীয় বিবেচনায় না হয়, সেদিকেও খেয়াল করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন সবার আগে কর্মহীন মানুষের তালিকা করে তাদের ত্রাণ দিতে। কিন্তু ওই তালিকা করতে গিয়ে অনেক সময় চলে যাচ্ছে। এ জন্য দিনমজুর, রিকশাচালক ও দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে যেতে হচ্ছে। জনে জনে গিয়ে তালিকা করতে অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় হচ্ছে।’ তিনি বলেন, দরিদ্রদের স্থায়ী কোনো তালিকা থাকলে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে অনেক সুবিধা হতো।