করোনা প্রায় সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত ৬০ জেলায় সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। কেবল পার্বত্য দুই জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি এবং সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহে এখনও কোনো সংক্রমণ ধরা পড়েনি। গতকাল শনিবার পর্যন্ত দেশে চার হাজার ৯৯৮ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশই সাত জেলার বাসিন্দা। বাকি ২০ শতাংশ ৫৩ জেলার। আর আট বিভাগের মধ্যে ৮৫ দশমিক ১১ শতাংশই ঢাকার। অন্য সাত বিভাগের বাসিন্দাদের মধ্যে আক্রান্তের হার ১৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩০৯ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় আক্রান্তের মোট সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৮ জন।
এই সময়ে আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, বাংলাদেশে এ রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪০ জন হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে শনিবার দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এই সবশেষ তথ্য তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম তিনজন রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল গত ৮ মার্চ; তার দশ দিনের মাথায় ঘটে প্রথম মৃত্যু।
গত এক দিনে নতুন করে কারও সুস্থ হয়ে ওঠার খবর আসেনি। এ পর্যন্ত মোট ১১২ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে নাসিমা সুলতানা জানান, আগের দিন শুক্রবার ছিল বলে দুয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা হয়নি এবং সেই রিপোর্টও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পায়নি।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এই সাত জেলার জন্য সরকারকে পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, অধিক সংক্রমিত জেলাগুলোর দিকে স্বাস্থ্য বিভাগকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনে কারফিউ জারি করে মানুষকে ঘরে রাখতে হবে। একইসঙ্গে এসব জেলায় প্রত্যেকটি এলাকা ধরে নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। এতে পজিটিভ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিকে আইসোলেশনে এবং তার সংস্পর্শে থাকা মানুষদের কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। অন্যথায় এটি দ্রুত গতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।
উচ্চঝুঁকিতে থাকা সাত জেলার চিত্র : আক্রান্তের তালিকা তৈরির কাজ করছে সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত দেশে যে চার হাজার ৯৯৮ জনের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছেন দুই হাজার ২৯৯ জন। মোট সংক্রমণের অর্ধেকেরও বেশি ঢাকায়। এর মধ্যে রাজধানীতে আক্রান্ত দুই হাজার ২২৮ জন। অর্থাৎ ৫১ দশমিক ৫০ শতাংশ। আরও ৭১ জন ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। এই হার এক দশমিক ৪২ শতাংশ। ঢাকায় মোট আক্রান্তের হার ৫২ দশমিক ৯২ শতাংশ। এরপরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ নারায়ণগঞ্জে ৫৯৪ জন। এই হার ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তৃতীয় গাজীপুরে ২৬১ জন। এই হার ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। চতুর্থ কিশোরগঞ্জে ১৮১ জন। এই হার ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। পঞ্চম নরসিংদীতে ১৪১ জন। এই হার ২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ষষ্ঠ ময়মনসিংহে ৮৭ জন। এই হার ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সপ্তম মুন্সীগঞ্জে ৬২ জন। এই হার ১ দশমিক ২৪ শতাংশ। সংক্রমিতদের প্রায় ৮০ শতাংশই এই সাত জেলার বাসিন্দা। সংক্রমিত ৬০ জেলার মধ্যে অন্য ৫৩ জেলায় আক্রান্তের হার ২০ শতাংশ।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিভাগের মধ্যে প্রথম আতঙ্ক ছড়িয়েছিল মিরপুরের টোলারবাগ ও মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা। শিবচরে ইতালি ফেরত প্রবাসীর মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ৩০ জন আক্রান্তের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল টোলারবাগ ও শিবচরের বাসিন্দা। দেশের প্রথম শিবচর উপজেলাকে লকডাউন ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন। টোলারবাগকেও লকডাউন করা হয়। এই লকডাউনের সুফল পেয়েছে দুই এলাকার মানুষ। সুতরাং এই দুটি স্থানের মতো অধিক সংক্রমিত দেশের সাত জেলার জন্যও একই পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে কারফিউ জারি করে মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রাখতে হবে। তাহলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, অধিক হারে সংক্রমিত সাতটি এলাকা নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে পৃথক করে ভাবতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিরপুর অঞ্চলের সবাইকে একদিনের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। এভাবে প্রত্যেকটি এলাকা ধরে নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে এবং তার সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। একইসঙ্গে এই সাত জেলাকে দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। তাহলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে। অন্যথায় ভাইরাসটি লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
বিভাগওয়ারি চিত্র- ঢাকা : সারাদেশে করোনা সংক্রমণের ৮৫ দশমিক ১১ শতাংশই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা। আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ২৯৯। ঢাকার বাইরে এ বিভাগের মাদারীপুর জেলায় ২৯ জন, মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ী ১২ জন করে, ফরিদপুরে ৯ জন, টাঙ্গাইলে ২২ জন, শরীয়তপুরে ১৪ জন ও গোপালগঞ্জে ৪৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম : মোট ১৭০ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। মোট হার ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় আক্রান্ত ৪৬ জন, কক্সবাজারে ৬ জন, কুমিল্লায় ৩৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৯ জন, লক্ষ্মীপুরে ২৮ জন, বান্দরবানে ৪ জন, নোয়াখালীতে ৫ জন, ফেনীতে ৩ জন ও চাঁদপুরে ১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
সিলেট : এই বিভাগে ৬৯ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মোট সংক্রমণের হার ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৪ জন, সুনামগঞ্জে ১৩ জন, হবিগঞ্জে ৪১ জন ও সিলেটে ১১ জন আক্রান্ত।
রংপুর : ৭২ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে রংপুর বিভাগে। মোট হার ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ১৮ জন, গাইবান্ধায় ১৬ জন, নীলফামারীতে ১০ জন, লালমনিরহাট ২ জন, কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়ে ৩ জন করে, দিনাজপুর ১৩ জন ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৭ জন।
খুলনা : এ বিভাগে ৩৮ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণের হার শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিভাগের খুলনা, যশোর ও নড়াইল জেলায় ৭ জন করে, মাগুরা ও মেহেরপুরে ২ জন করে, চুয়াডাঙ্গায় ৮ জন, কুষ্টিয়ায় ৪ জন ও বাগেরহাটে ১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
ময়মনসিংহ : এই বিভাগে ১৬৮ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের হার ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ৮৭ জন, জামালপুরে ৩৭ জন, নেত্রকোনায় ২৫ জন ও শেরপুরে ১৯ জন।
বরিশাল : ৮৬ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে। আক্রান্তের হার ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর মধ্যে বরগুনায় ২৩ জন, বরিশালে ৩৮ জন, ভোলায় ২ জন, পটুয়াখালীতে ১৯ জন, পিরোজপুরে ৭ জন ও ঝালকাঠিতে ৫ জন।
রাজশাহী : এই বিভাগে ৩৩ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের হার শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে জয়পুরহাটে ৪ জন, পাবনায় ৩ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ জন, বগুড়ায় ১১ জন, নওগাঁয় ও সিরাজগঞ্জে ২ জন করে এবং রাজশাহীতে ১০ জন শনাক্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি অধিক সংক্রমিত জেলাগুলো নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পৃথক পরিকল্পনা রয়েছে। একইসঙ্গে সারাদেশে যেসব অঞ্চলে ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়েছে, সেগুলোর বিষয়েও পরিকল্পনা হয়েছে। এই অঞ্চলে সংক্রমিত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে নেওয়ার পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জনসাধারণকে বারবার আহ্বান জানানোর পরও তারা ঘরে থাকছেন না। বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন। জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। এতে করে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে; যা রোগটি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।