ইফতারঃ বিরান চকবাজার, শূন্য বেইলি রোড

Untitled-45-samakal-5ea48f25b3c08

স্বাধীনতার আগে থেকেই চকবাজারে আসা-যাওয়া আছে লালবাগের হেলালউদ্দিনের। ১৬ বছর ধরে সেখানে পাহারাদারের চাকরি করেন ৬৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তি। এই দীর্ঘ জীবনে একটি দিনের জন্যও চকবাজারকে ফাঁকা দেখেননি। আর রোজায় চকের ইফতার বাজারের উপচেপড়া ভিড়ের সাক্ষী তিনি অর্ধশতাব্দি ধরে। এবারই প্রথম চকবাজারে ভূতুড়ে নীরবতা দেখলেন হেলালউদ্দিন। যেখানে ইফতারির দোকান বসত, সেখানে গতকাল শনিবার প্রথমবারের মতো বিরানভূমি, খাঁ খাঁ শূন্যতা।

লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮৯০ সালেও রমজানে চকবাজারে ইফতারি বিক্রি হতো। এরপর গত ১৩০ বছরে এর ব্যত্যয় হয়নি। কিন্তু ইতিহাস উল্টে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে থামিয়ে দেওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। করোনার বিস্তার রোধে জনসমাগম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তাই ইফতারির বাজার বসেনি চকে। ইফতারির পসরা বসেনি আরেক ঐতিহ্যবাহী বাজার বেইলি রোডেও।

রমজানে শুধু চকবাজার বা বেইলি রোড কেন, পুরো রাজধানীই পরিণত হয় ইফতার বাজারে। দুপুর থেকেই অলিগলিতে টেবিল পেতে বসে ইফতার সামগ্রীর পসরা। পাঁচতারকা হোটেল থেকে শুরু করে ফুটপাতের ‘আল ছালাদিয়া’- সর্বত্র উৎসবের আমেজে ইফতারি বিক্রি হতো। বিত্তবানরা ইফতারি বিলাতেন পথচারী ও গরিবদের জন্য। মসজিদে মসজিদে সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল ইফতারের আয়োজন।

সারাদেশকে ঘরবন্দি করে রাখা করোনা ইফতারের উৎসবও কেড়ে নিয়েছে। গতকাল প্রথম রোজার বিকেলে লালবাগ, আজিমপুর, চকবাজার, চানখাঁর পুল, বেইলি রোড, গুলশান ও ধানমন্ডি ঘুরে কোথাও ইফতারের আয়োজন দেখা যায়নি। পথের পাশে দুটি দোকান পাওয়া যায়, যেখানে বোতলে ভরা শরবত ও পানি বিক্রি করছেন দুই বিক্রেতা।

করোনার বিস্তার রোধে অঘোষিত লকডাউনে গত ২৬ মার্চ থেকেই রাস্তায় চলছে না যানবাহন। থেমে আছে জনজীবন। লকডাউনের ৩০ দিন পূর্ণ হয়েছে গতকাল। মাস পূর্তিতে রোজার প্রথম দিনে আরও জনশূন্য ছিল রাজধানীর পথঘাট। হাতেগোনা কিছু রিকশা আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যানবাহন চলাচল ছাড়া সড়ক শূন্য। জরুরি প্রয়োজনে যারা পথে বের হয়েছিলেন, তারা ইফতারের সময় ঘোর বিপাকে। কোথাও কিছু বিক্রি না হওয়ায় শুধু পানি দিয়ে ইফতার সারতে হয়েছে বহু রোজাদারকে। অথচ ঢাকা শহরে স্বাভাবিক সময়ে যা অকল্পনীয়।

গতকাল বিকেল ৫টার দিকে চকবাজারের পথে যেতে দেখা যায় উর্দু রোডের মুখ বাঁশ দিয়ে আটকানো। চকবাজারের দিকে যাওয়া মানা। চকবাজার থানা পুলিশের অনুমতি নিয়ে চকবাজার শাহী মসজিদের দিকে গিয়ে কিছুই দেখা হলো না। রমজানে শাহী মসজিদের সামনে বসত ইফতারের কাবাব, চকের মোড়ে বসত ‘বড় বাপের পোলায় খায়’-এর দোকান। রাস্তার দুই ধারের ‘বোম্বে সুইটস’, ‘আলাউদ্দিন’ ‘মুসলিম’ ও ‘ডিসেন্ট’র মতো প্রাচীন দোকানগুলোতে বিক্রি হতো মিষ্টি, শাহী জিলাপি, দইবড়া, শাহী পরোটা, কিমা পরোটা। গতকাল গিয়ে দেখা গেল, সব দোকান তালাবদ্ধ।

সেখানে কথা হয় বৃদ্ধ ইসমাইল আলী হাজির সঙ্গে। তিনি জানালেন, বাপ-দাদা তিন পুরুষ মিলে শত বছর ধরে চকবাজারে আছেন, ব্যবসা করছেন। কিন্তু এমন শূন্যতা কখনও দেখেননি, শোনেননি। আক্ষেপ করে তিনি বললেন, চকের মোড় থেকে শাহী মসজিদ মোটে ২০০ গজ পথ। রোজার সময় ভিড়ের কারণে এটুকু পথ যেতে এক ঘণ্টা লাগত। এখন একজন মানুষও নেই। কতদিন এভাবে চলবে, কে জানে।

চকবাজারে টহলে ছিলেন স্থানীয় থানার উপপরিদর্শক রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, জনসমাগম রোধে এবার বাজার বসানো নিষেধ। ব্যবসায়ীরা তা মেনে নিয়েছেন। কেউ ইফতারির দোকান বসাননি। তারপরও কয়েকজন আগ্রহী ক্রেতা এসেছিলেন। তাদের ঠেকাতে ব্যারিকেড দেওয়া আছে। কেউ চকে ঢুকতে পারবেন না।

ব্যারিকেড না থাকলেও চকের মতো শূন্যতা বেইলি রোডেও। বেইলি রোডে কিছু রিকশা ও হেঁটে চলা মানুষের আনাগোনা থাকলেও সড়কের দুই পাশের দোকানগুলো বন্ধ। ষাটের দশকে বেইলি রোডে যাত্রা করে ‘ফখরুদ্দিন ফুডস’। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি ও কাবাবের দোকানটি তালাবদ্ধ। অথচ রমজানের বিকেলে এই দোকানে থাকত ক্রেতাদের দীর্ঘ সারি।

একই চিত্র গুলশানেও। একটি দোকানও খোলা নেই নিকেতন থেকে গুলশান-২ মোড় পর্যন্ত। হাল আমলে ইফতারের বড় বাজার হয়ে উঠেছিল ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড। সড়কটির দুই পাশে অসংখ্য খাবারের দোকান। সেগুলো রোজায় ইফতারের দোকান হয়ে যেত। গতকাল তার একটিও খোলা ছিল না।

মূল সড়ক পেরিয়ে গলিপথে ঢুকে হাজারীবাগের তুলাগাছ তলায় একটি দোকান পাওয়া গেল। সেখানে সামান্য বেগুনি, পেঁয়াজু, ছোলাবুট বিক্রি চলছে। তাও আবার দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক ছিল বন্ধ। বিক্রেতা জানালেন, এক মাস ধরে বেকার বসে আছেন। ইফতারে যদি কিছু বিক্রি হয়, এ আশায় দোকান খুলেছেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে পুরো ঝাঁপ খুলতে পারছেন না।

Pin It