প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে ছড়াচ্ছে বাংলাদেশেও। এখন দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী। অরক্ষিত ঢাকায় সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট করোনা রোগীর ৮৩ ভাগই রাজধানীর। মৃতদের মধ্যে ৭০ ভাগই রাজধানীর বাসিন্দা। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া সাত জনের মধ্যে পাঁচ জনই ঢাকার। রবিবার পাঁচ জন মৃতের মধ্যে ঢাকার ছিল চার জন। বলা যায় দেশের রাজধানীতে করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে ব্যর্থ হওয়া এবং গার্মেন্টসকর্মীদের আসা-যাওয়ায় সুরক্ষাব্যবস্থা না থাকাই ঢাকায় সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ। বর্তমানে রাজধানীর রাজারবাগ, যাত্রাবাড়ী, বংশাল, মিটফোর্ড, উত্তরা, ওয়ারী, শাহবাগ, কাকরাইল, লালবাগ ও মহাখালী এলাকায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, রাজধানীতে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হওয়ার কারণ সচেতনতার অভাব। রাজধানীতে শিক্ষিত লোকের বসবাস। কিন্তু নিয়ম মানে না। এই অসচেতনতাই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এদিকে প্রতিদিনই রাজধানীর ঢাকায় নতুন নতুন এলাকায় করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যে রাজধানীর ৬৮টি স্পট লকডাউন করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি উড়ানো হয়েছে লাল পতাকা। ৪৫টির বেশি এলাকায় মিলেছে করোনা রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের সবকিছুর কেন্দ্র ঢাকায়। জাতির দুর্ভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা নিয়ে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তার ৫০ ভাগও বাস্তবায়িত হলে ঢাকায় করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এদিকে গার্মেন্টসগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। গার্মেন্টস খোলা-বন্ধ-খোলা নিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা গাদাগাদি করে থাকছেন। এটা অনেক ঝুঁকি। এসব অব্যবস্থাপনার চরম খেসারত দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আমাদের ওয়ার্কপ্ল্যান যেটা হচ্ছে সেটা যেমন পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না; তেমনি এসব ওয়ার্কপ্ল্যানের মধ্যেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় গত ১১ এপ্রিল রাজধানীর মোট ২০টি অভিজাত আবাসিক হোটেলের প্রায় ৬০০ রুমের তালিকা উল্লেখ করে বরাদ্দের অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। রাজধানীর ছয়টি হাসপাতালের সেবাদানকারীদের জন্য নির্ধারিত হোটেলগুলো হচ্ছে—কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের জন্য ঢাকা রিজেন্সি। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জন্য হোটেল অবকাশ, হোটেল জাকারিয়া, হোটেল রেনেসাঁ, ঢাকা রিজেন্সি, রেডিসন ব্লু, সোনারগাঁ, লেকভিউ ও লা মেরিডিয়ান। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের জন্য উত্তরার হোটেল মেলোলিফ ও হোটেল মিলিনা।
মিরপুরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্র্যান্ড প্রিন্স, হোটেল শ্যামলী ও হোটেল ড্রিমল্যান্ড। মহানগর জেনারেল হাসপাতালের জন্য রাজমণি ঈশাখাঁ ও ফারস হোটেল। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের জন্য হোটেল ৭১। রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের জন্য হোটেল সাগরিকা, হোটেল গ্র্যান্ড সারকেল ইন এবং হোটেল শালিমার।
এসব হোটেল থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের হাসপাতালে যাওয়া আসা করার কথা। কিন্তু ঐ সকল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে হোটেলের বিষয়টি সরাসরি মন্ত্রণালয় দেখবে। কিন্তু এ নিয়ে অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। করোনা রোগীর চিকিত্সার ব্যবস্থাপনা জোরদারের চেয়ে আর্থিক ব্যয় নিয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বেশি গুরুত্ব দেয়। অধিদপ্তরের এক জন কর্মকর্তা বলেন, এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে করোনা ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হচ্ছে। কোথায় করোনার চিকিত্সা হলো কিংবা রোগীরা চিকিত্সা পেল কি না তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, এই অবস্থায় রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্বর, সর্দি, কাশি, গলার ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের করোনার পরীক্ষা করতে হবে। এজন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার ডাক্তার-নার্স চাকরির অপেক্ষায় আছেন। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো মন্ত্রণালয়ের কোনো গুরুত্ব নেই।
স্বাস্থ্যখাতে অপচয় বেশি হচ্ছে! একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যখাতে অপচয় হচ্ছে বেশি। বিষয়টি তারা অনুসন্ধান করছেন। দুদকও মাঠে নেমেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে একের পর এক কোভিড-১৯-এর জন্য প্রস্তুত রাখতে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। ঐ সব কর্মকর্তাদের বিন্দুমাত্র জানা নেই যে, করোনার বাইরে প্রতিদিন দেড় লাখ রোগীর জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এসব রোগীর ৯০ ভাগেরই চিকিৎসাসেবা রাজধানী ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে চাপ পড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওপর।
রাজধানীর পাঁচটি সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জরুরি চিকিত্সাসেবার স্বার্থে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী, মিটফোর্ডসহ বড়ো বড়ো সরকারি হাসপাতালগুলো করোনা রোগীর চিকিত্সাসেবার বাইরে রাখা জরুরি। আর সর্দি, কাশি, জ্বর, গলাব্যথাসহ করোনা রোগীদের চিকিত্সাসেবার জন্য রাজধানীর আরো ৮/১০টি বেসরকারি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড করা জরুরি।