একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর ‘সংস্কারপন্থিরা’ নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার’ বাস্তবায়ন করতে চান তারা।
‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ (এবি পার্টি) নামের এই দলের সদস্য সচিব হয়েছেন সাবেক জামায়াত নেতা ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু।
শনিবার সকালে বিজয় নগরে ‘সায়হাম স্কাই ভিউ’ টাওয়ারে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের নাম ঘোষণার পাশাপাশি ২২২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়।
এ দলে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি একজন সাবেক সচিব।
দলের নাম ঘোষণার আগে সূচনা বক্তব্যে মঞ্জু বলেন, “আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল একটি শোষণমুক্ত ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যারা এটা মানেন না বা বিশ্বাস করেন না এবং এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে রাষ্ট্রকে ভুল পথে নিয়ে এসেছেন তারা কেউ দেশের প্রকৃত বন্ধু নন।
“আমরা মনে করি, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি এই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধ পরিকর।”
মুক্তযুদ্ধ নিয়ে দলের অবস্থান সম্পর্কে জামায়াতের সাবেক এই নেতা বলেন, “আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ ও পবিত্র ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি রাজনৈতিক অনৈক্য বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধকে স্বীয় সম্পত্তি বা একক অর্জন মনে করে অন্যদের সবার অবদানকে অস্বীকার করা এবং গড়পড়তা সবাইকে দেশবিরোধী ভাবা স্পষ্ট হটকারিতা ও স্বাধীনতার অঙ্গীকারের চরম লংঘন।
“অনুরূপভাবে নিজেদের ধর্মের একমাত্র সোল এজেন্ট এবং বাকিদের পথভ্রষ্ট, নাস্তিক, বিপথগামী ও মুনাফেক ভাবা চরম অন্যায় ও অধার্মিকতা। এবি পার্টি ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে।”
মঞ্জু বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সমান আচরণ এবং সামাজিক সুবিচার ও সাম্যের ভিত্তিতে একটি আধুনিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠিত হলেই কেবল মানুষের মুক্তি মিলবে। এবি পার্টির প্রধান লক্ষ্য হল একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।”
‘মতবাদ-মতাদর্শ যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার’- শ্লোগানকে ধারণ করে দল পরিচালনার ঘোষণা দেন মুজিবুর রহমান মঞ্জু।
জামায়াতের ‘সংস্কারপন্থিদের’ নতুন দল এবি পার্টি
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের দলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন আছেন। মিসেস বেবী পাঠান এখানে আছে। উনি বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের একজন নারী নেত্রী। উনার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু লেফট ব্যাকগ্রাউন্ড। উনি জাতীয় পার্টিতে ছিলেন। ব্যারিস্টার ফুয়াদ (আসাদুজ্জামান ফুয়াদ) উনি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না। ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম সাহেব একজন প্রফেশনাল ল’ ইয়ার হিসেবে (যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের উকিল) সংযুক্ত ছিলেন, পার্টির (জামায়াতে ইসলামী) সাথে সংযুক্ত ছিলেন না। এভাবে এই দলে বিভিন্ন দলের লোকেরা আছে।
“আপনারা আমাকে দেখে হয়ত বলতে পারেন আমার একটা স্ট্রং ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। আমি মনে করি যে, একটা রাজনৈতিক দলের প্রত্যেকের অতীত ইতিহাস থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো মুসলিম লীগ করেছিলেন। তাই না? উনি সেখান থেকে এসে নতুন একটা ধারণা দিয়েছিলেন। অনেকে সব সময় বলে যে, বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়। আমরা যে কথাগুলো বলছি খুবই সুস্পষ্ট। আমাদের কথা-বক্তব্য ও কর্মধারায় প্রমাণ হবে আমরা কোন রাজনীতি ধারণ করছি। সেটাকে আপনারা বিবেচনায় নেবেন।”
এবি পার্টির আহ্বায়ক হওয়ায় সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী বলেন, “করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর এই ক্রান্তিলগ্নে আমার ওপর এই গুরু দায়িত্ব আপনারা অর্পণ করেছেন। কর্মজীবনে দেশের কল্যাণে আমি সাধ্যমতো ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছি। দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজনীতির পরিবর্তে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হয়ে জীবনের শেষ সময়টুকু আমি অতিবাহিত করতে চাই। আপনারা দোয়া করবেন।”
নতুন রাজনৈতিক এই উদ্যোগের আহ্বান নিয়ে দেশের যে প্রান্তে গেছেন সেখান থেকেই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের ‘অকুন্ঠ সমর্থন’ পেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
সোলায়মান চৌধুরী বলেন, “দেশের যে কোনো নাগরিক আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, যে কোনো নাগরিক আমাদের গঠনমূলক কঠোর সমালোচনা করতে পারেন। তাদের সমালোচনা আমাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে এবং সামনে এগিয়ে চলার আলোকে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দেবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের আমি দেশবাসীকে শরিক হওয়ার আমি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আমাদের এই উদ্যোগ সফল হবে আমি আশা করি।”
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনের ব্যানারে লেখা ছিল, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ পুনর্গঠন করে নতুন রাজনৈতিক দল আমার বাংলাদেশ পার্টি-এবি পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন।
‘দলের নেতৃত্বে দুই মেয়াদের বেশি নয়’
মঞ্জু বলেন, “আমরা প্রস্তাব করেছি যে, এই দলের সভাপতি ও সেক্রেটারি তারা দুই মেয়াদের বেশি কেউ নির্বাচিত হতে পারবেন না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার যে সংস্কৃতি দেশে আছে এবি পার্টি সেটা থেকে মুক্ত থাকবে।
“আমাদের প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি- এখানে ব্যক্তির প্রাধান্য হবে না, নেতৃত্ব হবে সামষ্টিক বা কালেকটিভ। আমরা বলার চেষ্টা করছি যে, এখানে তুমি বা আমি নই, সবার আগে হবে দেশ। নেতা বা নেত্রীর বন্দনার যে কালচার বাংলাদেশের রাজনীতিতে হয়েছে সেটি থেকে আমাদের এই পার্টি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থাকবে।”
দলের কোনো ছাত্র শাখা থাকবে না জানিয়ে ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম বলেন, “আমাদের একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব করছি যে, প্রচলিত ধারার যে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি রয়েছে এবি পার্টি সেই ধরনের লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি করবে না। আমরা বলেছি, ১৮ বছরের উপরে বয়স হলে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক এবি পার্টির সদস্য হতে পারবেন।
“কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাঙ্গনে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, হানা-হানি, সিট দখল এবং যে অপরাজনীতি দেশে চালু আছে আমরা তার অবসান চাই। সেই অর্থে আমাদের লেজুড়বৃত্তি কোনো ছাত্র শাখা থাকবে না। তবে ছাত্ররা আমাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে দেশ পুনর্গঠন ও বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারবেন।”
সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে দলের একটি করে ‘শ্যাডো কমিটি’ বা ‘ছায়া কমিটি’ থাকবে, যারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে সুপারিশ ও দিক-নির্দেশনা দেবে বলে জানান তিনি।
তাজুল ইসলাম বলেন, “আমাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই পার্টিতে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী যে ৩৩% নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, সেটি আমরা রক্ষা করব আমাদের সকল স্তরের কমিটিতে।
“আমরা জাতির সামনে যে রাজনীতিটা নিয়ে আসতে চাই, সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে- গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পা ধরে সালাম করা এবং নেতা-নেত্রীর বন্দনা ছাড়া কোনো শব্দ উচ্চারণ যে করা যাবে না সেই ধরনের রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার জন্য ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’র এই রাজনীতি। আমাদের মূল কথা হচ্ছে- তুমি নই, আমি নই, সবার আগে বাংলাদেশ।”
তাজুল জানান, এবি পার্টি দলের নির্বাচন কমিটি গঠনের কার্যক্রম শেষ হলেই রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করবেন তারা।
লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক উনি একজন সজ্জন মানুষ, একজন প্রজ্ঞ আইনজীবী। আমরা যখনই উনার কাছে যে কোনো বিষয়ে সাহায্য চেয়েছি, পরামর্শ চেয়েছি আমরা উনার কাছ থেকে পেয়েছি। উনি আমাদের উপদেষ্টা, আমরা উনার কাছ থেকে উপদেশ নিয়ে থাকি এবং উনি যদি দেশে আসেন বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যখন যুক্ত হবেন তখন হয়ত আমরা খুব স্পষ্টভাবে আমরা আপনাদের কাছে বলতে পারব। এখন তার পরামর্শ ও উপদেশ নিয়েছি।
“শুধু ব্যারিস্টার রাজ্জাক সাহেব না, বাংলাদেশে অনেক খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী যারা আছেন আমরা সবার কাছ থেকেই…। যারা আমাদেরকে পছন্দ করেন আমাদের কাজকে সমর্থন করেন আমরা তাদের সমর্থন নিয়েছি। আপনারা দেখেছেন অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মিটিংয়ে এসেও আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন, অধ্যাপক ফজলুল হক, জনাব ইফতেখার আহমেদ, গৌতম দাশ এভাবে অনেকের নাম আমরা বলতে পারি যাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়েছি।”