এটা কি সত্যি, নাকি মায়াবী বিভ্রম! একটু আগেও ড্রেসিং রুমে যার হাত ছিল গলার সঙ্গে স্লিংয়ে ঝোলানো, সেই তামিম ইকবাল ব্যাট হাতে নেমে গেছেন মাঠে! চোখের সামনে দেখেও যেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়ে যান ক্রীড়া সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ। দুই বছর আগে এশিয়া কাপের ম্যাচে তামিমের সেই বীরোচিত কীর্তির আবেগ নাড়িয়ে দিয়েছিল পারভেজের পেশাদারিত্বের দেয়াল। সেদিন তার মন ভরিয়ে দিয়েছিল দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তোলা মুশফিকের অসাধারণ ইনিংসও।
২০১৮ এশিয়া কাপে দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের দুর্দান্ত জয়ের ম্যাচটি অনেক কারণেই স্মরণীয়। তবে সেদিন মাঠে থাকা পারভেজের মনে ম্যাচটি দাগ কেটে আছে মূলত দুটি কারণে। চোটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তামিমের মাঠে নেমে পড়া, আর তাকে আগলে রেখে মুশফিকের শেষের ঝড়।
বাংলাদেশের রোমাঞ্চকর কিছু ম্যাচ ও স্মরণীয় পারফরম্যান্স যারা মাঠে বসে দেখেছেন, তাদের নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন, ‘মাঠ থেকে দেখা।’ এই পর্বে দৈনিক কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি মাসুদ পারভেজ বলেছেন ২০১৮ এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচ নিয়ে।
হাথুরুসিংহের ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’
“এই ম্যাচের আগে দুই দলের সবশেষ দেখার ফল বাংলাদেশের জন্য ছিল হতাশার। দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়েকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজের শুরুতে শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পরের দুই ম্যাচে দেখতে হয় উল্টো চিত্র। প্রাথমিক পর্বের ফিরতি দেখায় শ্রীলঙ্কার কাছে ১০ উইকেটে হারার পর ফাইনালেও লঙ্কানদের বিপক্ষে হেরে যায় বাংলাদেশ।”
“বাংলাদেশের সাবেক কোচ হাথুরুসিংহে তখন শ্রীলঙ্কার কোচ। নিরপেক্ষ ভেন্যুতে তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশ কেমন করে, এটা দেখার প্রবল একটা আগ্রহ ছিল।”
“ম্যাচের আগের আলোচনার অনেকটাই ছিল হাথুরুসিংহেকে ঘিরে। জয়ের জন্য তিনি অনেক সময় ঘুরপথ অনুসরণ করেন। পথটা সঠিক নয়, কিন্তু তাকে ধরাও যায় না। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা তার এই কৌশলকে বলে থাকেন ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক।’ পাশাপাশি তারা এটাও বলেন, হাথুরুসিংহের এই ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ কাজ করে নিজের মাঠে কিংবা খুব পরিচিত মাঠে। দুবাই ছিল নিরপেক্ষ মাঠ। মাঠটি তার খুব পরিচিত নয়। এই কারণে বাংলাদেশের ছেলেদের বিশ্বাস ছিল, হাথুরুসিংহের কোনো কৌশল এখানে কাজ করবে না।”
“২৩ বছর পর ওই আসর দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। দীর্ঘ বিরতির পর মধ্যপ্রাচ্যে খেলতে যাচ্ছে দল, এ কারণে আগ্রহ ছিল আমার। আর এশিয়া কাপে আগের আসরগুলোয় বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল দারুণ। সব মিলিয়েই ওই টুর্নামেন্ট কাভার করতে আগ্রহী ছিলাম। সুযোগও মিলল।”
“হোটেল থেকে মাঠ খুব একটা দূরে ছিল না। ট্যাক্সিতে ১৫ মিনিটের পথ। কোনো জটিলতা ছাড়া যথা সময়ে মাঠে পৌঁছে যাই।”
তামিমের চোটে হঠাৎ ব্যস্ততা
“ম্যাচের শুরুতেই জোড়া ধাক্কায় টালমাটাল হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। প্রথম ওভারে লিটন দাস ও সাকিব আল হাসানকে ফিরিয়ে দেন মালিঙ্গা। দ্বিতীয় ওভারে চোট পেয়ে তামিম মাঠ ছেড়ে যান।”
“চোট সমস্যা কিন্তু বাংলাদেশকে আগে থেকেই ভোগাচ্ছিল। আঙুলের চোট নিয়েই ম্যাচটি খেলছিলেন সাকিব। দেশে থাকতে অনুশীলনের সময় আঙুলে চোট পান তামিম। শ্রীলঙ্কা ম্যাচের আগে মুশফিকের পুরনো পাঁজরের ব্যথা নতুন করে মাথাচাড়া দেয়।”
“চোট নিয়ে সিরিজের আগ থেকে লেখালেখি হচ্ছিল। ফিল্ডিংয়ে তামিমকে আড়াল করে রাখার ভাবনা ছিল। অথচ ফিল্ডিংয়ে নামার আগেই চোট পেলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ম্যাচের সময় তো ম্যানেজার ছাড়া দলের কেউ মোবাইল ব্যবহার করতে পারে না। তামিম চোট পাওয়ার পর প্রেসবক্সে থাকা সাংবাদিকরা সবাই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল, ম্যানেজার খালেদ মাহমুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য।”
“মাঠ থেকে হাসপাতালে গিয়ে স্ক্যান করিয়ে আবার ড্রেসিং রুমে ফিরেছিলন তামিম। ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ আমাকে বলেছিলেন, তামিম টুর্নামেন্ট থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়েনি। শুনে বিশ্বাস হয়নি। হবেই বা কেন? যার হাড়ে চিড় ধরেছে, সে কীভাবে ব্যাটিংয়ে নামবে! কোনোভাবেই কারও পারার কথা না। তার কথা শুনে তাই ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আবার উড়িয়েও দিতে পারছিলাম না। ম্যানেজারের কথার তো একটা ওজন আছে!”“তারপরও, তামিম ব্যাটিংয়ে ফিরবে শুনে আমরা হাসছিলাম। কারণ, আমরা বুঝতে পারছিলাম, এই ম্যাচ তো বটেই, তামিমের এশিয়া কাপই শেষ। যেহেতু হাতে চিড় ধরেছে, আর খেলা সম্ভব না। আমাদের কথা শুনে বিদেশি সাংবাদিকরাও বুঝতে পারছিলেন, কিছু একটা হয়েছে। তারাও ম্যানেজারের কোট নিয়ে নিউজ করেছিলেন।”
যেন পরবাস্তব কোনো দৃশ্য
“৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হলেন মুস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের ইনিংসও সেখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিছুক্ষণ আগেও টিভিতে দেখাচ্ছিল,
হাত স্লিংয়ে ঝুলিয়ে বসে আছেন তামিম। সেই তিনিই নেমে গেছেন ব্যাটিং করতে!”
“সে সময়ে বোলিংয়ে ছিলেন সেই সুরঙ্গা লাকমল, যার বলে চোট পেয়ে ইনিংসের শুরুতে মাঠ ছেড়েছিলেন। এখন আমার প্রথম যে কথাটা মনে পড়ছে, তামিম মাঠে নামার সময় সবাই যখন তুমুল আলোড়িত, আমি তখন টেনশনে ঘামছিলাম! কারণ, আমার ল্যাপটপ তখন আপডেট নিচ্ছিল। রোমাঞ্চ-আবেগ-উত্তেজনা, সবকিছুর আগে আমাদের কাছে পেশাদারিত্ব। দেশে নিউজ পাঠানোর ডেডলাইন পার হয়ে যাচ্ছিল, মিনিট পনের মতো বাকি ছিল। প্রেসবক্সের এসি খুব ঠাণ্ডা, এরপরও ঘামছিলাম। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সময় মতোই নিউজ পাঠাতে পেরেছিলাম।”
“তামিমের ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়াটা ছিল বিস্ময়কর। জাগতিক কোনো কিছু দিয়ে তার ব্যাটিংয়ে ফেরা ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমার কাছে এটা ব্যাখ্যাতীত। যেন পরাবাস্তব কোনো ঘটনা। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। যার হাত ছিল স্লিংয়ে ঝোলানো, আমরা খবর পেয়ে গেছি যে টুর্নামেন্ট তার শেষ, সেই মানুষ কীভাবে ব্যাট হাতে নেমে পড়েন! মনে হচ্ছিল, এটি সত্যি নয়। তামিম ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলটি খেলার আগ পর্যন্ত এরকমই অনুভূতি ছিল সম্ভবত মাঠে থাকা সবারই।”
“উদ্বেগ ছিল, উৎকণ্ঠা ছিল। নিজের চোখে অমন বীরত্ব দেখার অদ্ভূত একটা শিহরণও ছিল মনে। এমন দৃশ্য তো বলে কয়ে দেখা যায় না। জানি না, পরের ১০ বছরেও এমন দৃশ্য আর দেখব কী না।”
যেমন ছিল প্রেসবক্স-মাঠের অবস্থা
“এশিয়া কাপের সেটি ছিল উদ্বোধনী ম্যাচ। প্রেস বক্সে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের পাশাপাশি ভারতীয়, পাকিস্তানি ও শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকরাও ছিলেন। আমাদের মত তারাও বিভিন্ন আপডেট দিচ্ছিলেন। তামিমের এশিয়া কাপ শেষ, এমন খবর তারাও দিয়েছিলেন। এরপরও নবম উইকেট পতনের পর তামিম যখন ক্রিজে চলে এলেন, তাদের কয়েকজনকে আক্ষরিক অর্থেই স্রেফ হা হয়ে যেতে দেখলাম। এমন কিছু তাদের দূরতম কল্পনাতেও ছিল না।”
“দুবাইয়ে বাংলাদেশের দর্শক ছিল প্রচুর। দেশের মাটিতে কোনো ম্যাচে জয়ের সময় কিংবা জয়ের পরিস্থিতি তৈরি হলে দর্শকরা যে চিৎকার দেয়, সেটি আমার অন্যতম সেরা স্মৃতি। সেদিন তামিম যখন নামে, তখন কিন্তু ম্যাচের মাঝামাঝি। সেই সময়ও ‘তামিম, তামিম’ বলে যেভাবে চিৎকার করছিলেন দর্শকেরা, এখনও যেন তা শুনতে পাই। দলের জয়ের সময়ের গগণবিদারী চিৎকারের মতোই ছিল অবস্থা।”মুশফিক মাস্টারক্লাস
“মুশফিকের ইনিংসটা ছিল অসাধারণ। আমার মতে, এটা তার খেলা সেরা তিনটি ইনিংসের একটি। শুরুতে মোহাম্মদ মিঠুনের সঙ্গে জুটিতে দলকে টেনে তুলেছিলেন বিপর্যয় থেকে, এরপর শেষ পর্যন্ত দলকে এগিয়ে নিয়ে নিজে অপরাজিত থাকেন ১৪৪ রানে।”
“চোট নিয়েও ব্যাটিংয়ে যাওয়ার পর তামিম কেবল একটি বল খেলেন। এরপর মুশফিক নিশ্চিত করেছেন স্ট্রাইক ধরে রাখা, একই সঙ্গে বড় শট খেলে শেষের দাবি মেটানো। তামিম ব্যাটিংয়ে নামার পরই কিন্তু মুশফিক রানটা বেশ বাড়িয়ে নিয়েছে। ১৬ বলের জুটিতে আসে মহামূল্য ৩২ রান। সব রানই করেন মুশফিক।”
তামিম টনিকে রেকর্ড গড়া জয়
“তামিমের মাঠে ফেরাটা দলের জন্য টনিকের মতো কাজ করেছিল। তামিম নামার সময়ই মনে হয়েছিল, এই ম্যাচে বাংলাদেশের জয় লেখা হয়েই গেছে। গোটা দলকে উজ্জীবিত করেছিল দারুণভাবে। তামিমের ব্যাটিংয়ে ফেরাটা পুরো ম্যাচের মোড় পাল্টে দেয়।”
“শেষ পর্যন্ত সেটিই হয়েছে। ২৬১ রানের পুঁজি নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। ১৩৭ রানের সেই জয়, দেশের বাইরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। আর এশিয়া কাপে সেটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় হার। ওই ১২৪ বাংলাদেশের বিপক্ষে লঙ্কানদের সর্বনিম্ন রানও।”
“মুশফিকের ১৪৪ রানের চেয়ে সেই সময়ে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের বড় স্কোর ছিল একটি, তামিমের ১৫৪। এশিয়া কাপে সেটির চেয়ে বড় ইনিংস আছে কেবল একটি, বিরাট কোহলির ১৮৩।”
“বাংলাদেশের দলীয় রানের ৫৫.১৭ শতাংশ এসেছিল মুশফিকের ব্যাট থেকেই। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের যা রেকর্ড।”
“তবে সেসব অর্জন, রেকর্ড ওই ম্যাচ শেষেও ছিল অনেকটা আড়ালে, এখনও সেসবের চর্চা হয় কম। ওই ম্যাচ মানেই কেবল তামিমের বীরত্বগাঁথা আর মুশফিকের দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানশিপের প্রদর্শনী।”