মহামারীতে অর্থনীতিতে ওলট-পালটে রপ্তানি আয় নামল রেমিটেন্সের অর্ধেকে

ppe-manufacture-010420-21

গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই ওলট-পালট এখন কোভিড-১৯ মহামারীতে; তার ধাক্কায় উল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাবনিকাশও।

ওলট-পালটের এই ধারায় বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো মাসে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্সের চেয়ে পণ্য রপ্তানি আয় কম হয়েছে। শুধু কমই নয়, অর্ধেকে নেমেছে।

বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে মাত্র ৫২ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এই একই মাসে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি যে রপ্তানি আয় রেমিটেন্সের চেয়ে কম হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেও ১০৮ কোটি ডলার রেমিটেন্স

পণ্য রপ্তানিতেও বড় ধস

করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী রূপ নেওয়ার পর গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিই স্থবির হয়ে পড়েছে, যা আরেকটি মহামন্দার শঙ্কা জাগিয়েছে।

এই কারণেই বাংলাদেশের রপ্তানির এই দুর্দশা।

এই মহামারীর প্রভাব শুরু হওয়ার আগের যে কোনো মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সব সময়ই রেমিটেন্সের চেয়ে আড়াই-তিন গুণ বেশি বিদেশি মুদ্রা এসেছে পণ্য রপ্তানি করে।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৫৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। ওই মাসে রপ্তানি আয় ছিল ৩৫৮ কোটি ১৯ লাখ ডলার।

পুরো অর্থবছরের হিসাব বিশ্লেষণ করলেও বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ মোট ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল। আর রেমিটেন্স এসেছিল ১ হাজার ৬৪২ কোটি (১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি হল রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স।

দুই সূচকের এমন প্রবণতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ সত্যিই সবকিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। আমি কখনই ভাবিনি, রপ্তানি আয়ের চেয়ে রেমিটেন্স বেশি আসবে।”

তবে এই সঙ্কটকালে বহু প্রবাসী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ায় সামনে রেমিটেন্সেও ধাক্কা আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আহসান মনসুর।

“পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে রেমিটেন্সেরও একই হাল হবে। এখানে মনে রাখতে হবে, এখন উপার্জন বা কাজের টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন না প্রবাসীরা। জমানো টাকা যা ছিল, তা থেকে অথবা অন্য কারও কাছ থেকে ধার করে পরিবারের বিপদের দিনে কিছু পাঠাচ্ছেন। সেটা ফুরিয়ে গেলে আর পাঠাতে পারবেন না।”

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। জ্বালানি তেলের দাম একেবারে কমে আসায় তেলনির্ভর অর্থনীতির ওই দেশগুলোতেও দেখা দিয়েছে বড় সঙ্কট।

“সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে রেমিটেন্সের জন্যও খুব ভালো সময় আসবে বলে মনে হয় না।”

৯ মাসের রপ্তানির চিত্রই আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছিল

৯ মাসের রপ্তানির চিত্রই আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছিল

৯ মাসের রপ্তানির চিত্রই আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছিল

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয় গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৮২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম।

এবারের লক্ষমাত্রার চেয়ে ৮৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম রপ্তানি আয় এসেছে। গত এপ্রিলে লক্ষ্য ছিল ৩৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার আয়ের।

গত বছরের এপ্রিলে রপ্তানি হয়েছিল ৩০৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতি-বাণিজ্য তছনছ এখন কোভিড-১৯ মহামারীতে।

সংক্রমন এড়াতে লকডাউন বা অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশগুলো। এতে দোকান-পাট রয়েছে বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ বাতিল কিংবা স্থগিত করেছেন।

এপ্রিলের আগের মাস মার্চেও রপ্তানি কম হয়েছিল। তবে মার্চ মাসে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব পুরোপুরি বোঝা যায়নি। ফলে ওই মাসে রপ্তানি হ্রাসের হার ১৮ শতাংশের মধ্যে ছিল।

মার্চে নতুন রপ্তানি আদেশ প্রায়ই বন্ধ হওয়ায় এপ্রিলে পণ্য জাহাজীকরণ হয়নি বললেই চলে। একারণেই পণ্য রপ্তানি আয় তলানিতে নেমে এসেছে।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৯৪৯ কোটি ৩৪ লাখ (২৯.৪৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ০৯ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩৭ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৩৩ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য ছিল ৩১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের এই ১০ মাসে আয় হয়েছিল ২৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

এ হিসাবে এই ১০ মাসে লক্ষ্যের চেয়ে পোশাক রপ্তানি কমেছে ২২ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ১৪ দশমিক ০৮ শতাংশ।

পোশাক রপ্তানি তলানিতে  

পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে বলে মনে করছেন- এই প্রশ্নে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের প্রধান সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, “জানি না ভাই, কী যে হবে… দেখতেই তো পাচ্ছেন…।”

আর নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান বলেন, “সঙ্কট কাটিয়ে উঠার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে কারখানা চালু রাখছি; উৎপাদন হচ্ছে। সরকারও সহায়তা দিচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।”

করোনাভাইরাস: আশঙ্কায় এখনই দিশেহারা পোশাক শিল্প মালিকরা  

আশা দেখাচ্ছে শুধু পাট

এই সঙ্কটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। যেখানে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, চামড়াসহ সব খাতের অবস্থাই করুণ।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৭৯ কোটি ১৩ লাখ ডলার আয় করেছে।

এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৬৯ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের এই ১০ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৬৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার।

আশা দেখাচ্ছে একমাত্র পাট  

ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৩ শতাংশের মতো।বাকি অন্য সব খাতেই কমেছে। চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ১৯ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। তাতে প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।

Pin It