করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ১১০টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সুবিধাসম্পন্ন বড় বড় স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এসব হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা হবে, একইসঙ্গে সেবা পাবেন সাধারণ রোগীরাও। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার তেমন কাজে আসছিল না। সংক্রমণের ভয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার যেগুলো চালু আছে, সেখানে করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া সাধারণ রোগীরাও সেবা পাচ্ছেন না। চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রোগীর পথেই মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে রোগী ও তাদের স্বজনদের এমন বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।
নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশি চিকিৎসকদের যারা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আছেন, তারা নতুন একটি পদ্ধতির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে পাঠিয়েছেন। সেটি হলো- প্রত্যেকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালকে তিনটি জোনে ভাগ করা হবে। কভিড, নন-কভিড ও প্রাথমিক জোন। করোনা সন্দেহভাজন রোগীরা প্রাথমিক জোনে অবস্থান করবেন। নমুনা পরীক্ষার পর পজিটিভ হলে কভিড জোনে তাকে ভর্তি করা হবে। আর করোনা নেগেটিভ হলে নন-কভিড জোনে ভর্তি করা হবে।
ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই পদ্ধতিটি নিয়ে আমরা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা ইতিবাচক মত দিয়েছেন। তবে এটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই পদ্ধতি চালুর পর সংক্রমণ ঝুঁকি আরও বাড়বে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি হাসপাতালেই পৃথক জোন করা হবে। সুতরাং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে না। বিষয়টি নিয়ে শনিবার একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অন্যান্য কার্যক্রমের কারণে সেটি হয়নি। আজ রোববার অথবা আগামীকাল এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। সবার মতামতের আলোকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নতুন এই চিকিৎসা পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ট্রিটমেন্ট প্রটোকল প্ল্যানের অন্যতম সদস্য ও সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চালু থাকা সরকারি ও বেসরকারি ১১০টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে। এর বাইরেও কিছু বড় হাসপাতাল আছে। এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে একটি দক্ষ জনবল রয়েছে। এর সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। এসব পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালকে করোনার চিকিৎসাসেবায় যুক্ত করার একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ডা. এম এ ফয়েজ আরও বলেন, প্রত্যেকটি হাসপাতালে তিনটি জোন থাকবে। করোনা পজিটিভ রোগীরা কভিড জোনে এবং নেগেটিভ রোগীরা নন-কভিড জোনে সেবা পাবেন। একই সঙ্গে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোও কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। অন্যান্য রোগীর বিষয়টি বিবেচনা করে এই পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
একই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে কিনা এমন প্রশ্নে ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, যারা করোনা রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকবেন, তাদের সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হবে। সুতরাং বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হবে না। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের বাইরে অনেক হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্স আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে সুরক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটি আসলে গবেষণা করার বিষয় যে, করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল না হলেও সেখানে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে। রোগীর তথ্য লুকানো, পিপিই ও মাস্ক সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারা, পিপিই সঠিকভাবে ডিসপোজাল না করাসহ অনেক কারণেই সংক্রমণের ঘটনা ঘটতে পারে।
স্বাস্থ্য বিভাগে মোট প্রতিষ্ঠান ও শয্যাসংখ্যা : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬৫৪টি হাসপাতালে ৫১ হাজার ৩১৬টি শয্যা রয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫ হাজার ৫৫ হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলিয়ে রয়েছে ৯০ হাজার ৫৮৭টি শয্যা। সরকারি ও বেসরকারি মিলে মোট ১ হাজার ১৬৯টি আইসিইউ শয্যা আছে। স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা চিকিৎসার জন্য ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলায় ১ হাজার ৯৬টি কভিড ডেডিকেটেড শয্যা এবং ৪৭টি আইসিইউ প্রস্তুত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের সাত জেলায় ১ হাজার ৯৮টি সাধারণ শয্যা এবং ৩৪টি আইসিইউ শয্যা, ময়মনসিংহের চার জেলায় ৩৮০টি সাধারণ এবং সাতটি আইসিইউ শয্যা, বরিশালের ছয় জেলায় ৪১৩টি সাধারণ এবং ১৮টি আইসিইউ শয্যা, সিলেটের চার জেলায় ৩৪৮টি সাধারণ এবং ১৬টি আইসিইউ শয্যা, রাজশাহীর আট জেলায় ৯২৪টি সাধারণ এবং ২৮টি আইসিইউ শয্যা, খুলনার আট জেলায় ৭১৩টি সাধারণ এবং ১৮টি আইসিইউ শয্যা, রংপুরের আট জেলায় ৭২২টি সাধারণ এবং ১৩টি আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ২ হাজার ৯০০ সাধারণ, ১৪৮টি আইসিইউ এবং ১০২টি ডায়ালাইসিস শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আট বিভাগে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৮ হাজার ৫৯৪টি সাধারণ, ৩২৯টি আইসিইউ এবং ১০২টি ডায়ালাইলিস শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনা মিলে মোট শয্যা আছে এক লাখ ৪১ হাজার ৯০৩টি। অর্থাৎ আরও এক লাখ ৩৩ হাজার ৩০৯টি শয্যা ফাঁকা পড়ে আছে। এর বাইরে করোনা আক্রান্তদের জন্য আট বিভাগে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য ৬১৫টি প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত করা হয়েছে। যেখানে মোট ৩০ হাজার ৯৯৫ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করা যাবে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার ৩৩৯ জন কোয়ারেন্টাইনে আছেন।
নতুন পরিকল্পনায় ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা : করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেওয়া নতুন চিকিৎসা পরিকল্পনায় আরও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, প্রত্যেকটি হাসপাতাল তিনটি জোনে ভাগ হলেও চিকিৎসা দিতে গিয়ে পরস্পরের সংস্পর্শে আসতে হবে। একসঙ্গে সব চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী এভাবে যুক্ত হয়ে চিকিৎসায় নিয়োজিত হলে সংক্রমণ যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কী হবে? তখন তো নূ্যনতম চিকিৎসা দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না। যা করার ভেবেচিন্তে করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সরকার যে পরিকল্পনা করছে, তাতে সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেই ঝুঁকি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নেই। এই প্রক্রিয়ায় রোগীদের পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরাও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে চলে যাবেন। সুতরাং এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের আগে আরও চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনা ও নন-করোনার পুরোপুরি পৃথক হাসপাতাল থাকতে হবে। নন-করোনা হাসপাতালে কোনো করোনা পজিটিভ রোগী যাবে না। তবে নন-করোনা হাসপাতালে একটি ফ্লু কর্নার, একটি জরুরি বিভাগ এবং একটি বহির্বিভাগ থাকবে। ওই আউটডোরের মধ্যে একটি ফ্লু কর্নার থাকবে। যেসব রোগীর জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হবে, সে করোনা কিংবা নন-করোনা যাই হোক তাকে জরুরি বিভাগে সেবা দিতে হবে। এরপর পরীক্ষা করে পজিটিভ হলে রোগীকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠানো হবে। এই পরীক্ষার আগে পর্যন্ত ওই রোগী সংশ্নিষ্ট হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে থাকবে। ফ্লু কর্নারে থাকা রোগীদেরও পরীক্ষা করতে হবে। করোনা পজিটিভ হলে তাদের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে আর নেগেটিভ হলে সংশ্নিষ্ট হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। ভর্তির প্রয়োজন না হলে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ট্রিটমেন্ট প্রটোকল প্ল্যান কমিটির সদস্য ও ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রিসার্চ সেন্টারের প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে ওই পরিকল্পনাটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সমমানের নয়। কোনো রোগী হাসপাতালে পৌঁছার পর নূ্যনতম ১৬ ঘণ্টার আগে আমরা পরীক্ষা করে তার রেজাল্ট দিতে পারছি না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে হাসপাতালে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে রেজাল্ট দিতে পারে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। বাংলাদেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এটি সম্ভব নয়। সুতরাং এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে আরও চিন্তাভাবনা করতে হবে।
ডা. রিদওয়ানুর রহমান আরও বলেন, হাসপাতালগুলোকে তিনটি জোনে ভাগ করার আগে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবার নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। একই সঙ্গে রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্যও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং রোগী ও তাদের স্বজনরা পরস্পরের সংস্পর্শে গিয়ে রোগটি আরও ছড়িয়ে দেবে। একসঙ্গে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর সবাই আক্রান্ত হলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।