প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নথি জালিয়াতির মামলায় গ্রেপ্তার একজন অফিস সহকারী সরকারপ্রধানের অভিমত সম্বলিত একটি নথি মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বের করে দেওয়ার কথা ‘স্বীকার করে’ আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার ওসি শামীম উর রশিদ জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস সহকারী ফাতেমাকে রোববার প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি ঢাকার একজন মহানগর হাকিমের কাছে ‘দোষ স্বীকার করে’ জবানবন্দি দেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তিনজনের নামের প্রস্তাব সম্বলিত ওই নথিতে প্রধানমন্ত্রী অভিমত দেওয়ার পর তা কার্যালয় থেকে বের করে ‘জালিয়াতির মাধ্যমে’ সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়া হয়। পরে আবার সেই নথি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় বঙ্গভবনে।
জালিয়াতির ঘটনাটি ধরা পড়লে প্রাথমিক অনুসন্ধানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি তরিকুল ইসলাম মুমিন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরহাদ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস সহকারী ফাতেমার ‘সম্পৃক্ততা’ বেরিয়ে আসে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ মোহাম্মদ রফিকুল আলম বাদী হয়ে গত ৫ মে তেজগাঁও থানায় মামলা করার পরদিন ভোলা থেকে ছাত্রলীগ নেতা তরিকুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
একই রাতে নোয়াখালী থেকে ফরহাদ এবং রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে নাজিমউদ্দিন নামে বিনিয়োগ বোর্ডের একজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শনিবার ওই তিনজনকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চাইলে প্রত্যেকের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
এরপর রোববার প্রথম প্রহরে মতিঝিল সরকারি টিঅ্যান্ডটি কলোনির বাসা থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অফিস সহকারী ফাতেমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক শামীম বলেন, “আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে ফাতেমা মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওই নথিটি বের করে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের নামও বলেছেন।”
আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর ফাতেমাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এনামুল হক, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. আব্দুর রউফ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর এম আবদুস সালাম আজাদের নাম প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নথি পাঠানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী নথি দেখে অধ্যাপক ড. এম এনামুল হকের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেন। কিন্তু চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য নথিটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর আগেই সেটি বাইরে চলে যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বদলে প্রথম দুইজনের নামের পাশে ‘ক্রস’ চিহ্ন দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যজনের নামের পাশে সম্মতিজ্ঞাপনের ‘টিক’ চিহ্ন দেওয়া হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ছাত্রলীগ নেতা মুমিন ‘মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে’ এই কাজ করেছেন।
“আবদুস সালাম আজাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তিনি এই কাজ করেছেন কি না তা যাচাই করে দেখা হবে। প্রায়াজনে সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খতিয়ে দেখা হবে।”
তবে এ বিষয়ে কোনো আর্থিক লেনদেনের কথা অস্বীকার করেছেন আবদুস সালাম আজাদ।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়ার ঘটনায় তেজগাঁও থানায় যে মামলা হয়েছে সেখানে তার নাম আছে এটা তিনি শুনেছেন।
রোববার রাতে এই কথোপকথনে প্রথমে তিনি দাবি করেন, এ মামলায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের কাউকে তিনি চেনেন না। এই ঘটনার সাথে তার কোনো ‘সম্পর্ক নেই’।
পরে এক প্রশ্নের জবাবে আবদুস সালাম আজাদ স্বীকার করেন, তরিকুলের সাথে তার ফোনে দুই-একবার কথা হয়েছে। তরিকুল তাকে বলেছিলেন তারা বিভিন্ন জায়গায় ‘কিছু কাজ করার চেষ্টা করেন’। তার কাজটাও করতে চান।
“তরিকুল নিজে থেকে যোগাযোগ করেছিল কিছু করে দেওয়ার জন্য। আমি তাকে নিষেধ করেছি। আর অর্থিক কোনো লেনদেন হয়নি।”
তবে তরিকুলের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি আবদুস সালাম আজাদ।
তিনি বলেন, “হয়ত কারও কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে কথা বলেছে।”
জালিয়াতি করে তার নামের পাশে কেন টিক চিহ্ন দেওয়া হয়েছে, তার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দিয়েছেন আবদুস সালাম আজাদ।
“আমি ধারণা করছি, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়ার কাজটি যারা করেছে তারা অন্যদের বিপক্ষে করতে গিয়ে আমার পক্ষ নিয়ে ফেলেছে।”
তবে কাউকে এখনও সন্দেহের বাইরে রাখছেন না জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা শামীম উর রশিদ বলেন, তিন আসামি আরও দুই দিন রিমান্ডে আছে। এই সময়ে তাদের কাছে এ সংক্রান্ত আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টা করা হবে।
“তদন্তের কোনো পর্যায়ে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকেও (আবদুস সালাম আজাদ) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
আজাদ বলেছেন, তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইলে সব ধরনের সহযোগিতা তিনি করবেন।
গ্রেপ্তার বিনিয়োগ বোর্ডের কর্মচারী নাজিমউদ্দিন ‘অত্যন্ত ধূর্ত’ মন্তব্য করে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “এ ধরনের কাজে সে সিদ্ধহস্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগেও সে এ ধরনের কাজ করেছে বলে কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব যাচাই করে দেখা হচ্ছে।”