৪৫ হাজার দর্শকে ঠাসা গ্যালারি যেন টগবগ করে ফুটছিল উত্তেজনায়। শেষ জুটিতে ভারত এগিয়ে যাচ্ছিল জয়ের দিকে। গ্যালারিতে তখন অনিশ্চয়তার ঢেউ। মাঠে বসেই প্রবল উৎকণ্ঠায় ছিলেন মোহাম্মদ খাইরুল আমিন। দেশের মাটিতে অধরা জয়ের দেখা মিলবে? নাকি ফিরতে হবে স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রণা নিয়ে! অবশেষে আফতাব আহমেদের দুর্দান্ত এক থ্রোয়ে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার অবসান। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের জনসমুদ্রে বয়ে গেল যেন উল্লাসের সুনামী। যে এক অবিশ্বাস্য ক্ষণ !
এরপর? একটু ভেবে খাইরুল বললেন, “আর মনে নেই!” মুহূর্তটাই ছিল উচ্ছ্বাসে অমন হারিয়ে যাওয়ার! প্রায় ১৬ বছর আগের সেই দিনটি আসলে এখনও জ্বলজ্বল করে ইতিহাসের এই প্রত্যক্ষদর্শীর মনে। বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে, সেই ম্যাচেই দেশের মাটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক জয়। টইটম্বুর গ্যালারি। উপলক্ষ্য অমনভাবে রাঙিয়ে রাখার দিনটি তিনি ভোলেন কী করে!
বাংলাদেশের রোমাঞ্চকর কিছু ম্যাচ ও স্মরণীয় পারফরম্যান্স যারা মাঠে বসে দেখেছেন, তাদের নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধারাবাহিক আয়োজন, ‘মাঠ থেকে দেখা।’ এই পর্বে ক্রীড়া সাংবাদিক খাইরুল আমিনের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম জয়, প্রথমবার ভারত-বধের কীর্তি।
পেশাগত কাজে নয়, খাইরুল সেদিন মাঠে গিয়েছিলেন স্রেফ খেলা দেখতে। পরে বাংলাদেশের আরও অনেক বড় বড় জয় দেখেছেন মাঠে বসে। সমৃদ্ধ হতে দেখেছেন অর্জনের ডালি। তবে, ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ভারতের বিপক্ষে ১৫ রানে জয়ের ম্যাচটি বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে তার মনে।
সব পথ মিশেছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে
সেদিনের আধা বেলা হরতাল ঠেলে সব মানুষ যেন জড়ো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। বলতে গেলে পুরোটা সময় জুড়েই শোনা যাচ্ছিল বাংলাদেশের নামে শ্লোগান। দুপুরে মাঠে ঢোকার সময়ে এত দর্শক দেখে চমকে গিয়েছিলেন খাইরুল।
“৪৫ হাজারের মতো দর্শক হয়েছিল। অবাক করা ব্যাপার। অনেকেই ভেবেছিল, এত দর্শক হবে না। মূলত হরতালের জন্যই। মাঠের দিকে যখন যাচ্ছি, তখনই দেখি দর্শকের স্রোত। চারদিকে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ চিৎকার। বিস্ময়কর। আগের ম্যাচেই হেরেছে দল, এরপরও এত দর্শক, ম্যাচ শুরুর আগেই এমন গর্জন! ”
“মনে আছে, আমি মাঠের চারপাশে এক চক্কর ঘরে এসেছিলাম। কেমন লাগে, সেটি অনুভব করতে। বাইরের অবস্থা তখন বর্ণনাতীত ছিল। এত এত মানুষ এই হরতালের মধ্য ঠেলে-ঠুলে চলে এসেছে। অভাবনীয় ব্যাপার।”
শুরুতেই চমকআগের ম্যাচের একাদশ থেকে চারটি পরিবর্তন এনেছিল ভারত। বিশ্রামে ছিলেন শচিন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, হরভজন সিং, ইরফান পাঠান।
প্রথম ম্যাচ জিতে সিরিজে এগিয়ে ছিল ভারত। কিন্তু সিরিজ জয় নিশ্চিত হওয়ার আগেই টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়দের বিশ্রাম দেওয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না ভারতীয় সাংবাদিকরা। প্রেস বক্সে তাদের প্রতিক্রিয়া এখনও খাইরুলের চোখে ভাসে।
“ভারতীয় সাংবাদিকরা বিস্মিত ছিল। শচিন, দ্রাবিড়, হরভজন নাই সিরিজ নিশ্চিত করার আগেই। ভারতের এতগুলো পরিবর্তন নিয়ে আমরাও অবাক ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ কতটা কী করতে পারবে (লড়াই), কেউই হয়তো ততটা ভরসা করতে পারেনি।”
ব্যাটিংয়ের সময় ভারত যখন বিপদে, ভারতীয় সাংবাদিকদের কথায় বারবার ফিরে আসছিল টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়দের বিশ্রাম দেওয়ার প্রসঙ্গ। খাইরুলের মতে, সেটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার।
“ভারতীয় সাংবাদিকরা টিপ্পনি কাটছিল, এবার বোঝো, টেন্ডুলকারকে খেলাবা না, দ্রাবিড়কে বসিয়ে রাখবা! এমন করলে যে মাশুল দিতে হয়, সেটা আজকেই দিতে হবে।”
“নিশ্চয়ই তারা সেটা চাচ্ছিল না। এটাও হয়তো স্বীকার করতে চাচ্ছিল না যে, সেদিন ভারতের চেয়ে অনেক ভালো ছিল বাংলাদেশ। পূর্ণ শক্তির দল থাকলেও যে বাংলাদেশ জিতত না, এর তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
বাংলাদেশ একাদশ সাজিয়েছিল চার পেসার নিয়ে। সেই সময়ের তরুণ গতি তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজা ওয়ানডে খেলতে নেমেছিলেন ১৫ মাস পর।
২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার সময় চোট পেয়ে লম্বা সময়ের জন্য ছিটকে গিয়েছিলেন মাশরাফি। দীর্ঘদিন পর ফেরার ম্যাচে সবার চাওয়া ছিল, একুট সাবধানী থাকুক মাশরাফি। কিন্তু খাইরুল মাঠে দেখেন উল্টো চিত্র।
“মাশরাফির ১৫ মাস পর ফেরা নিয়ে কথা হচ্ছিল। তার আগের চোটটা ছিল ফলো থ্রুয়ে ডাইভ দিতে গিয়ে। সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল, মাশরাফি যেন এমন কিছু না করে, আবার চোট যেন না পায়। তারপরও তাকে দেখা গেল পয়েন্টে ফিল্ডিং করতে, ক্লোজে ফিল্ডিং করতে। মাঠে সেদিন দারুণ প্রাণবন্ত ছিলেন মাশরাফি।”
ফেরার ম্যাচটি ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে রাঙিয়ে ম্যান অব দা ম্যাচ হয়েছিলেন মাশরাফি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার।
বাজে শুরুর পর ত্রাতা আফতাবমোহাম্মদ রফিককে ওপেন করিয়ে বেশ কবারই সফল হয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সেদিন ফাটকা কাজে লাগেনি। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামার পর দ্বিতীয় ওভারেই জহির খানের বলে বোল্ড হয়ে যান রফিক।
শুরুতেই মিইয়ে যাওয়া দর্শকদের ক্রিজে গিয়েই মাতিয়ে তোলেন হাবিবুল বাশার। রফিক আউট হওয়ার ওভারেই বাংলাদেশ অধিনায়ক চার বলের মধ্যে বাউন্ডারি মারেন তিনটি।
সেই যুগে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের একটা চেনা চিত্র ছিল। শুরুতে একটা উইকেট পড়বে। ক্রিজে গিয়ে হাবিবুল কিছু শট খেলবেন। এরপর একশ রানের ভেতরে দল ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলবে। পরের ব্যাটসম্যানরা মাটি কামড়ে চেষ্টা করবে ৫০ ওভার খেলার। সেদিনও সেই পথেই হাঁটছিল দল।
৮৮ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন খাইরুলও।
“ জয়ের কথা তো আমাদের ভাবনতীত ছিল তখন, ব্যক্তিগত অর্জনের দিকেই নজর থাকত। চ্যালেঞ্জ তখনও ছিল, কিন্তু ম্যাচ জেতার নয়। তখন ৫০ ওভার খেলতে পারাই বিরাট ব্যাপার। কিন্তু সেদিন দাঁড়িয়ে গেলেন আফতাব আহমেদ।”
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আফতাব তখনও নবীন। সেটি ছিল তার সপ্তম ম্যাচ। ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটিতে ৯৮ বলে পাঁচ চার ও এক ছক্কায় করেছিলেন ৬৭ রান। এই পরিসংখ্যানে অবশ্য ফুঠে উঠছে না, মন্থর উইকেটে কঠিন সময়ে ভারতীয় বোলিংয়ের বিপক্ষে সেদিন কতটা দাপট দেখিয়েছিলেন তরুণ আফতাব।
পেছন ফিরে তাকিয়ে খাইরুল মনে করেন, ওই ইনিংস দিয়েই দেশের ক্রিকেট দর্শকদের কাছে নিজেকে চিনিয়েছিলেন আফতাব।
“আফতাব তখনও একেবারে নতুন। দর্শকরা সেভাবে তার সামর্থ্যের কথা জানতো না। মূলত সেই ম্যাচ থেকে আফতাবকে চিনেছিল তারা। একেকটা বাউন্ডারিতে গ্যালারিতে সে কী প্রতিক্রিয়া ! এখন যা হয়, এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল। ‘আফতাব, আফতাব’ শ্লোগানের জন্ম সম্ভবত সেদিনই।”
ম্যাচের নায়ক মাশরাফিপ্রত্যাবর্তনের অসাধারণ এক গল্প রচনা করেছিলেন সেদিন মাশরাফি! আগে ব্যাট হাতে, পরে বোলিংয়ে।
আফতাবের ইনিংসের পরও দুইশর নিচে গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ছিল দল। ৯ নম্বরে নেমে মাশরাফি খেলেছিলেন ৩ চার ও ১ ছক্কায় ৩১ রানের ইনিংস। নবম উইকেট তাপস বৈশ্যর সঙ্গে গড়েছিলেন ৩৯ রানের মহামূল্য জুটি, পরে ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে সেই জুটিই। বাংলাদেশ তোলে ২২৯ রান।
ব্যাটিংয়ে দলকে উদ্ধারে পর বোলিংয়েও শুরুর আঘাত মাশরাফির হাত ধরেই। ইনিংসের তৃতীয় বলে দুর্দান্ত এক ইনকাটারে বোল্ড বিরেন্দর শেবাগ।
খাইরুল স্মৃতির আয়নায় তাকিয়ে দেখেন, এই এক উইকেট দর্শকদের কাছে ছিল তিন উইকেটের সমান।
“বিপজ্জনক শেবাগকে ঝড় তোলার আগেই থামালেন মাশরাফি। অসাধারণ এক ডেলিভারিতে এলোমেলো স্টাম্প। টেন্ডুলকার, দ্রাবিড়ের না থাকাটা তখন অনেক বড় হয়ে গেল। দর্শকদের জন্য ব্যাপারটা ছিল এমন, যেন তিন উইকেট নেই! শ্লোগানের তীব্রতা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল।”
“মাশরাফি সেদিন যেখানেই হাত দিয়েছে, সোনা ফলেছে। ব্যাটিংয়ে সেই সময়ে নিজের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেছে। শেবাগকে বোল্ড করার পর মহেন্দ্র সিং ধোনিকে ফিরিয়েছে। ধোনি কিন্তু গিয়েই মারতে শুরু করেছিল, তাকে আউট করাটা খুব জরুরি ছিল। ফিল্ডিংয়ে দুটি ক্যাচ নিয়েছে। সব মিলিয়ে দিনটি ছিল মাশরাফির।”
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
বাংলাদেশের পুঁজি ছিল মাঝারি। তবে বোলিংয়ের শুরুতে মাশরাফির ছোবলের পর থেকেই দল ছিল দারুণ উজ্জীবত। জমে উঠল ম্যাচ। দুর্দান্ত বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডিং ছিল অসাধারণ; চিতার ক্ষিপ্রতায় বাউন্ডারি বাঁচানো, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট। সবই হচ্ছিল।
তারপরও মিলবে কী জয়? দোটানায় ছিলেন খাইরুল।
“ওদের উইকেট পড়া শুরু হলো। দর্শকের সঙ্গে আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করলাম…। মোহাম্মদ কাইফ ঝুঁকিপূর্ণ রান নিতে গিয়ে ধরা পড়ল; রাজিন সালেহ বাতাসে শরীর ভাসিয়ে সরাসরি থ্রোয়ে অবিশ্বাস্য রান আউট করল। আউট ভারতের শেষ বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান।”
এক দিকে জয়ের হাতছানি, আরেক দিকে শঙ্কা। তীরে এসে তরী ডুববে না তো। ভারতের আশা হয়ে তখনও ক্রিজে টিকে যোগিন্দর শর্মা। শেষ ব্যাটসম্যান মুরালি কার্তিক ক্রিজে যাওয়ার সময় সমীকরণ ছিল, ২৪ বলে প্রয়োজন ২৬। রান কার কত ওভার বাকি, এ সব নিয়ে আলোচনা চলছিল। উৎকণ্ঠায় সবাই।
“শেষ উইকেট না পড়া পর্যন্ত কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি যে বাংলাদেশ জিতবে। অনেক সময় হয় না, সবশেষ জুটি ম্যাচ বের করে নিয়ে যায়! তবে, আফতাবের থ্রোয়ে আরেকটা রান আউট। জিতে যায় বাংলাদেশ।”
বাঁধনহারা উদযাপন
বাংলাদেশের জয় তখন বিরল। জয় কীভাবে উদযাপন করতে হয়, সেটিও ছিল অনেকটা অজানা। আগের পাঁচটি জয় এসেছিল দেশের বাইরে। দেশের মাটিতে প্রথম জয়ের উদযাপনটা কেমন হয়, দেখতে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন খাইরুল।
“আফতাবের থ্রোয়ে যখন ম্যাচ শেষ হয়ে গেল, তখন দেখার বিষয় ছিল বাংলাদেশ উদযাপন কীভাবে করে। দেশের মাটিতে এতো বড় দলের বিপক্ষে জয়। মনে হয়, তারা নিজেরাও বুঝতে পারছিল না উদযাপনটা কীভাবে করবে।”
“সবাই তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছিলেন। তখন এই উদযাপনটা বেশ মজার মনে হয়েছে। ম্যাচের মধ্যেও উইকেট পড়লে ওইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে উদযাপন করতেন। যখন ফিরছিলেন, তখনও লাফাচ্ছিলেন। মূল উদযাপনটা হয়েছিল কোচ ডেভ হোয়াটমোরকে নিয়ে। ঝড়ের গতিতে ল্যাপ অব অনার করেছিল পুরো দল।”
“শুরুতে হোয়াটমোর আবেগের প্রকাশ খুব একটা দেখাননি। গম্ভীর ভাব নিয়ে ছিলেন। এরপর যখন উৎসব শুরু হলো, পৃথিবীর অন্যতম সুখী মানুষ তাকেই মনে হচ্ছিল। তিনিও সেই উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন।”
খাইরুলের একটা চোখ ছিল ভারতীয় দলের ওপরও। মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন তাদের প্রতিক্রিয়া।
“ অধিনায়ক সৌরভ তো আগেই আউট হয়ে গিয়েছিল। তার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল। ভারতীয় দলের সবার মুখ অন্ধকার হয়ে ছিল। থমথমে একটা অবস্থা ছিল। তারা ভাবতেই পারেনি, ম্যাচটা এভাবে হাত থেকে চলে যাবে।”
“শেষ দিকে ওদের কাউকে কেউ হাসতে দেখেনি। পুরোটা সময় ওদের মুখ ছিল থমথমে। সংবাদ সম্মেলনে সৌরভ হালকা করতে চাইলেও ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছিল। সেদিন অনেক বেশি সমীহ দিয়ে কথা বলেন তিনি।”
দর্শকরা ছিল পাগলপ্রায়
এত দিন বাংলাদেশের জয় দেখতে হয়েছে টিভিতে। এবার সরাসরি। গ্যালারিতে ছিল আবেগের জোয়ার। সম্পূর্ণ অচেনা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছে। সঙ্গে চলছে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান। দৃশ্যগুলো কখনও ভুলবেন না খাইরুল।
“দর্শকরা তো প্রথম বল থেকে চিৎকার করছিল। তারা স্রেফ পাগল হয়ে গিয়েছিল। কে কী করবে, কোনো ঠিক ছিল না। একে জড়িয়ে ধরছে, ওকে জড়িয়ে ধরছে। চিৎকার করছে, হইচই করছে। বিরাট উৎসব হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ জয়ের উৎসব করছিল। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে শ্লোগান দিচ্ছিল। খেলোয়াড়দের নাম ধরে ধরে চিৎকার করছিল। মাশরাফির নামে শ্লোগান বেশি ছিল।”
“এমনিতে ম্যাচ শেষ হলেই দর্শকদের একটা অংশ চলে যায়। সেদিন চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গেটের কাছাকাছি দাঁড়াতে। দল যখন মাঠ ছাড়বে তখন যেন একটু দেখতে পারে কিংবা শ্লোগান দিয়ে দলকে অভিনন্দন জানাতে পারে। টিম বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল হাজার হাজার মানুষ। ম্যাচ শেষের পরও দর্শকরা লম্বা সময় ছিল। অবশ্য দল বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। ওই রাতেই তাদের সংবর্ধনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।”
‘সরি টেন্ডুলকার’সে সময় নিয়মের এত কড়াকড়ি ছিল না। সরাসরি ড্রেসিংরুমেও যেতে পারতেন সাংবাদিকরা। খাইরুলও গিয়েছিলেন বাংলাদেশের উদযাপন দেখতে। তখনকার একটি ঘটনা তার মনে পড়ে।
“ ড্রেসিং রুমের সামনে লবিতে যাচ্ছি। তখন তো সবাই খুব রোমাঞ্চিত। সে জন্য হয়তো খেয়াল করিনি। সিঁড়িতে কার সঙ্গে যেন ধাক্কা লাগল। তাকিয়ে দেখি, দুই বগলে চারটার মতো ব্যাট আর হাতে গ্লাভস… শচিন টেন্ডুলকার! তিনি নামছিলেন। কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, ‘খুব দুঃখিত।’ ওই দিন কী আর ‘সরি’ নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকে কারও!”
“ড্রেসিং রুমের সামনে যাওয়ার পর শুভেচ্ছা বিনিময় চলছিল সবার। খেলোয়াড়রা অন্তত একবার করে চেহারা দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। হাসি বিনিময়, দুয়েকটা কথা। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম জয় বলে কথা।”
দুই অধিনায়কের জন্য দুই রকম ছিল সংবাদ সম্মেলন। অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন হাবিবুল। সৌরভ পড়েছিলেন তোপের মুখে। খাইরুলদের জন্য সেটা ছিল বিশেষ অভিজ্ঞতা।
“বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তখন যেটা হতো, প্রেস কনফারেন্সে কোনো ব্যক্তিগত অর্জন উঠে আসত। সেদিন ছিল বিরল, আলোচনায় দলীয় অর্জন।”
কী ভেবে এসেছিলেন আর কী হলো, রাতে বাড়ি ফেরার সময় তার হিসেব মেলাচ্ছিলেন খাইরুল। হয়তো সবাই এটিই ভাবছিলেন!
“সেদিন কাজ ছিল না। প্রেস বক্সে ছিলাম। গ্যালারিতে গিয়েছি। অদ্ভূত একটা দিন ছিল। সকালে পেয়েছিলাম ভয়াবহ সুনামির খবর। ঢাকায় অর্ধ দিবস হরতাল ছিল। সব শেষে দেখা গেল, সেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় মাইলফলকের একটি দিন।”
“১০ দিন আগে এই মাঠেই বাংলাদেশ উদযাপন করেছিল মহান বিজয় দিবস। এরপর সেই মাঠেই দেশের মাটিতে প্রথম জয়। আজও মনে দাগ আছে, এই স্মৃতি কখনও ভোলার নয়।”