করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরেছেন, তা বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এ লক্ষ্যকে বলেছেন ‘হাস্যকর’; আর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেছেন ‘অবাস্তব’।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ই কোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রবৃদ্ধির ওই লক্ষ্যের দিকে ইংগিত করে প্রশ্ন করেছেন- মহামারী কী তাহলে শেষ হয়ে গেছে?
অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন তাতে অর্থনীতিতে মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, বরাদ্দে মনোযাগ পেয়েছে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা আর কৃষি খাত।
বিদায়ী অর্থবছরের ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও কোভিড-১৯ দুর্যোগের মধ্যে তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে।
মহামারীর মধ্যে থমকে যাওয়া অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি সচল করার মত পরিস্থিতি কবে হবে সেই নিশ্চয়তা এখনও নেই। তারপরও আগের বারের মতো ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্য ধরে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকার বনানীতে এক কর্মশালায় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এই লক্ষ্যকে ‘কল্পনাপ্রসূত’ আখ্যায়িত করে আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককে বলেন, “অর্থমন্ত্রী জিডিপির কি লক্ষ্য ধরলেন বুঝতে পারছি না। কোথা থেকে আসবে এই প্রবৃদ্ধি? আমরা অর্থনীতিবিদরা পাঁচ-সাড়ে পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরতে বলেছিলাম। সেখানে ৬ শতাংশ ধরা যেতে পারত। ধরা হল বিদায়ী বাজেটের মতই ৮ দশমিক ২ শতাংশ!”এই লক্ষ্যকে ‘হাস্যকর’ হিসেবে বর্ণনা করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “এই মহামারীর সময় দেশের প্রতিটি মানুষ আতঙ্কিত-ভীত, রপ্তানি আয় আর রেমিটেন্স কমছে, আমদানি তলানিতে নেমে এসেছে। কতদিন এই অবস্থা থাকবে অনিশ্চিত।
“তারপরও ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কোন যাদুর বলে আসবে?”
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বাংলাদেশ চলতি অর্থ বছরের জন্যও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল।
কিন্তু মহামারীর মধ্যে দুই মাসের লকডাউন আর বিশ্ব বাজারের স্থবিরতায় তা বড় ধাক্কা খেয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা পুরোপুরি আত্মপ্রত্যয়ী ছিলাম যে এ বছর আমাদের অর্থনীতিতে সেরা প্রবৃদ্ধিটি উপহার দিতে পারব। আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রাটি ছিল ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৩ ভাগ।
“কিন্তু করোনার প্রভাব সারাবিশ্বের অর্থনীতির হিসাব-নিকাশকে সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট করে দিয়েছে।”
তারপরও ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করার কথা জানিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, “ইকোনমিস্ট গত ২ মে ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে নবম স্থানে রেখেছে। তাদের হিসাবে আমরা অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছি।”
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার ‘ইয়ুথ অনট্রাপ্রনারশিপ: হাউ টু স্টার্ট উইথ’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলামও জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যকে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করছেন না।তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, বিশ্ব ব্যাংক যেখানে আগামী অর্থবছরে এক শতাংশ মতো প্রবৃদ্ধির কথা বলেছে, সেখানে এই ‘টার্গেট’ কীভাবে সম্ভব?
“প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ শতাংশ ধরা যেত। জিডিপির এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট নেওয়া হয়েছে সেটাও বাস্তবসম্মত নয়। এটা অর্জন করা সম্ভব নয়।”
মহামারীর মধ্যে গত তিন মাস ধরেই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির, শিল্প উৎপাদনও গতিহারা। আমদানি-রপ্তানি নেমে এসেছে তলানিতে। ফলে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এনবিআর।
তারপরও অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মধ্যে তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ৮.৫ শতাংশ বেশি। আর নতুন বাজেটের ৬৬ শতাংশ।
নতুন অর্থবছরের বাজেটের ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
এটা করতে গেলে বেসরকারি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মন্তব্য করে মির্জ্জা আজিজ বলেন, “এই বিপুল অর্থ ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন না। এতে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে।”
সেলিম রায়হান বলেন, “আমরা কি অনুমান করে নিচ্ছি যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে এবং তাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮% এর ওপরে যে গতিধারায় ছিল সেখানে ফিরে আসবে? তার অর্থ হচ্ছে অর্থনীতি পুনরায় দ্রুত সচল হয়ে উঠবে, যেটাকে আমরা ‘ভি শেপড রিকভারি’ বলি। বাস্তবতা তা বলছে কি না সেটা একটা প্রশ্ন থেকে যায়।”
বিবর্ণ এক পরিবেশ সুরা বাক্বারাহ দিয়ে শেষ করলেন অর্থমন্ত্রী
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে ৩৫০ এমপির এক-তৃতীয়াংশেরও কমসংখ্যক এমপির উপস্থিতি ছিল গতকাল সংসদে বাজেট পেশের দিনে। ছিল না কোনো উচ্ছ্বাস। বরং মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে আসা সংসদের সদস্যদের সবার মধ্যেই ছিল করোনাভীতি, অজানা এক উদ্বেগ-আতঙ্ক।বাজেট পেশের দিন প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি ব্রিফকেস বা ব্যাগ হাতে অর্থমন্ত্রী যখন অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন তখন উপস্থিত সদস্যরা সবাই আনন্দচিত্তে টেবিল চাপড়ে তাদের অভিনন্দন জানান। এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তবে করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী তাদের দুজনের মধ্যে ছিল দূরত্ব। এবারও টেবিল চাপড়িয়েছেন উপস্থিত থাকা সীমিতসংখ্যক এমপিরা। তবে সেই টেবিল চাপড়ানোর মধ্যেও যেন কোনো আনন্দ ছিল না। গত বেশ কয়েক বছর ধরে এমপি ও সাংবাদিকদের বাজেট ডকুমেন্টারি দেওয়া হতো পাটের তৈরি বিশেষ একটি আকর্ষণীয় ব্যাগে ভরে।
অধিবেশন কক্ষে প্রত্যেক এমপির আসনের সামনে টেবিলের ওপর আগে থেকেই দেওয়া থাকত সেই ব্যাগ। প্রতি আসনের সামনে একটি করে ব্যাগের কারণে ভিন্ন এক দৃশ্যে সাজত অধিবেশন কক্ষ। এবার শুধু অপরিহার্য বাজেট ডকুমেন্টারি সরবরাহ করা হয়েছে খামে ভরে। সংসদ ভবনের ভেতরে সাংবাদিকদেরও প্রবেশ ছিল না। সংসদ ভবনে থাকা মিডিয়া সেন্টার থেকে সাংবাদিকরা বাজেট ডকুমেন্টারি সংগ্রহ করেছেন। সাংবাদিকবিহীন এমন অধিবেশনও আগে কখনো কেউ দেখেননি।
বাজেট পেশের দিন সাধারণত বিকালে শুরু হয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য চলে সন্ধ্যার পর দীর্ঘ সময় ধরে। এবার বেলা ৩টায় শুরু হয়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই সংসদের বৈঠক শেষ হয়েছে। প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী সংক্ষিপ্ততম বাজেট-বক্তব্য রেখেছেন সংসদে, তার বক্তব্যের বড়ো অংশই পঠিত বলে গণ্য করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
দীর্ঘ বাজেট বক্তব্য উপস্থাপনকালে অতীতে সব সময়ই অর্থমন্ত্রীকে কিছুক্ষণ পরপর পানি বা ফ্লাক্সে রাখা গরম চা পান করতে দেখা যেত। এবার সেটিও করতে হয়নি মুস্তফা কামালকে। ব্যক্তিগতভাবে এটা ছিল তার জীবনের দ্বিতীয় বাজেট উপস্থাপন। তাকেও হাসিখুশি দেখা যায়নি।
বাজেট বক্তৃতার প্রারম্ভে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুঃখের বিষয়, করোনার প্রভাব সারা বিশ্বের অর্থনীতির হিসাব-নিকাশকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দিয়েছে।’ আর অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্য শেষ করেন সুরা আল বাক্বারাহর ১৫৫ নম্বর আয়াত পাঠ এবং এর বাংলা অনুবাদ করে। আল্লাহ যেন তার রহমত থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত না করেন—সেই প্রার্থনা দিয়েই বক্তব্যের ইতি টেনেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী আরবিতে সুরা আল বাক্বারাহর ১৫৫ নম্বর আয়াত পাঠ করেন।
বলেন, ‘এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবই; মাঝেমধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও।’ এ সময় মহান আল্লাহর দরবারে অর্থমন্ত্রী প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি তোমার রহমত থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত কোরো না।’
পরিশেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি তার সৃষ্টির অকল্যাণে কিছুই করেন না, যা করেন কল্যাণের জন্যই করেন। তাই অবশ্যই অচিরেই তিনি তার কল্যাণের সুশীতল ছায়ায় আমাদেরকে আশ্রয় দিয়ে মহামারি ভাইরাস থেকে সবাইকে পরিত্রাণ দান করবেন এবং আমরা ফিরে যাব আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, উন্মোচিত হবে এক আলোচিত ভোরের।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৩ জুন একাদশ সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি ছিল দেশের ৪৮তম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২০তম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট।
ঐ সময় অর্থমন্ত্রী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত থাকায় কয়েক মিনিট সূচনা বক্তব্য রাখেন। পরে তার পক্ষে পুরো বাজেট বক্তৃতাটি পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে লোটাস কামাল এবার যখন দ্বিতীয় বাজেট ঘোষণা করলেন তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী চলছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ।