মহামারীর মধ্যে সংকট মোকাবেলায় গুরুত্ব না দিয়ে গতানুগতিক বাজেট দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই বাজেট প্রকৃত অর্থে একটি ‘অন্তঃসারশূন্য-কল্পনাপ্রসূত কথার ফুলঝুরি’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
শুক্রবার বিকালে উত্তরার বাসা থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপি মহাসচিব।
বাজেটের সুনির্দিষ্ট বেশ কয়েকটি দিক ধরে সমালোচনা করেছেন তিনি। সাবেক মন্ত্রী ফখরুলের মতে, ‘লুটপাটের খাত’ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ না করে সেখানকার এক লাখ কোটি টাকা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা উচিত ছিল।
অর্থনীতির সাবেক শিক্ষক মির্জা ফখরুল বলেন, “করোনা কাটিয়ে একটি টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাজেটে নেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রত্যাশিত অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম, জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র করে এই বাজেটটা প্রণয়ন হবে, সেটা তো হয়নি।
“‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে এই বাজেট প্রকৃত অর্থে একটি অন্তঃসারশূন্য কল্পনাপ্রসূত কথার ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বাজেট জনবান্ধব হয়নি।”
বাজেট ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন জাতির জন্য, মানুষের জন্য, মানুষগুলো বেঁচে থাকার জন্য, উত্তরণ ঘটানোর জন্য-কোনোটাই এই বাজেটে আসেনি। এখানে যেটা এসেছে আমরা বলেছি তাদের যে চিন্তাটা কমিশন পাওয়া এটা এখানে (বাজেট) এসেছে।”
প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল-ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি না করে ‘বর্তমান ব্যয়’ বহাল রাখার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন ‘অসম্ভব’ মনে করছেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, “সরকার বলছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশ। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ২০২০ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে এবং ২০২০-২১ সালে হবে মাত্র ১ শতাংশ। সেখানে অর্থমন্ত্রী জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন।
“আমদানি, রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি মাইক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটরগুলো আলোচনা করলেই স্পষ্ট যে, ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত। এটা করতে গেলে বিনিয়োগ দরকার ৩২-৩৪ শতাংশ, যা কঠিন ও অসম্ভব।”
রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা ‘প্রতারণার শামিল’ বলে মন্তব্য করেন ফখরুল।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “গত এক দশকের অধিককালব্যাপী সরকার দলীয় যে সকল ব্যক্তি নজিরবিহীন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে, তাদের টাকা সাদা করার জন্য সরকার এবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। আমরা এহেন অনৈতিক, দুর্নীতি সহায়ক, বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া লক্ষাধিক কোটি টাকার যে খতিয়ান দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এটা একেবারেই ঠিক হয়নি, এই খাতে আরও অনেক বেশি বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল। এটা শুধু আমরা বলছি না, যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন তারাও এই কথাটা বলছেন। আপনি দেখুন সারা দেশে আইসিইউ সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্স নাই, জেলাগুলোতে কোনো আইসিইউ খুঁজে পাবেন না। ঢাকা শহরের মধ্যে সরকারি হাসপাতালগুলো আছে যেগুলো আপনারা কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানেও কিন্তু পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। মানুষ অক্সিজেন অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য হাহাকার করছে।
“আপনি স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা দেখছেন- কীভাবে এই খাত ভেঙে পড়েছে, ভঙ্গুর হয়ে গেছে। মানুষ কোথাও কোনো রকম চিকিৎসা পাচ্ছে না। দেখুন বলা যেতে পারে যে, আল্লাহর ওপরে সব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঠেলা গাড়িতে করে রোগী নিয়ে যায় ভর্তি হতে পারে না, সেখান থেকে মৃতদেহ নিয়ে বাসায় আসছে। এই যে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, তাদের অহংকার, তাদের দাম্ভিকতা এবং তারা নিজেরাই সব কিছু করতে পারবে এই যে একটা ধারণা, এই ধারণাই বাংলাদেশকে এই অবস্থায় ফেলেছে।”
সরকারের রাজস্বের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে ফখরুল বলেন, “রেভিনিউ আর্নিং- টাকাটা আসবে কোত্থেকে? সরকার যেভাবে বলছে সেভাবে টাকা তো আসবে না। ৫০% এর অধিক রেভিনিউ হতে হবে যে বাজেট দেওয়া হয়েছে। ওইটা বলে তো লাভ নেই, এটা অবাস্তব হবে। আর টাকা কোত্থেকে আনবেন?
“সেজন্য আমরা বলছি যে, মেগা প্রজেক্টগুলোতে শুধু দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলোতে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে অথবা বিলম্ব করে অনায়াসে নিতে পারতেন জরুরি খাতগুলোতে। রূপপুর আনবিক প্রকল্প, এটাতে কি বরাদ্দ দেয়া এসেনশিয়াল হয়ে পড়েছে? এমনিতেই বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হয়ে আছে বলে আপনারা (সরকার) বলছেন। তাহলে রূপপুর আনবিক প্রকল্পে এখন বরাদ্দের দরকার কী?”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা যেসব কথা এখন বলছি এটা শুধু আমাদের কথা নয়, যারা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আছেন এবং যারা বিভিন্ন সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তারা সবাই কিন্তু এক বাক্যে এই কথাটা বলছেন যে, এই বাজেটটা করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য একেবারেই উপযোগী নয়।
“আসলে এখন আপদকালীন বাজেট করা উচিত ছিল। সামনে তো ভয়ঙ্কর অবস্থা আসবে। মাইক্রো ইকোনমিক্সের অবস্থা কী হবে সেটা যারা ভুক্তভোগী তারাই বলতে পারবেন অর্থাৎ সমগ্র দেশের মানুষ সেটা বলতে পারবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার এটা উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা সেই চিরায়ত গতানুগতিক লক্ষ্য তো একটা- কী করে সেখান থেকে কিছু টাকা পয়সা বানানো যায়- স্যরি টু সে দ্যাট। দ্যাট হ্যাজ বিন ডান ইন দিজ কান্ট্রি। এটাই করা হচ্ছে।”
শিক্ষা খাত, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা, বেকারত্ব দূরীকরণ, কৃষিখাত, কুটির শিল্পখাত, পল্লী উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা ‘অপ্রতুল’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব। পানি সম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে বরাদ্দ কমানো, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রবাসী ও পোশাক শিল্প খাতের বিষয়ে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো দিক-নির্দেশনা না থাকারও সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।
বাজেটে ব্যাংকিং খাতসহ অর্থনীতিকে ‘পুনরুদ্ধারের কোনো সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব নেই’ মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “বরং শীর্ষ খেলাপিদের ঋণ পরিশোধে আরও সময় বৃদ্ধি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতকে আরও সংকটের দিকে ঠেলে দেবে, আর্থিক শৃঙ্খলা আরও ভেঙে পড়বে।”
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ নিয়ে তিনি বলেন, “উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। করোনা সংকট মোকাবিলায় মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এই উন্নয়ন খাত থেকে এক লাখ কোটি টাকা করোনা সংকট মোকাবিলায় দেওয়া দরকার। কারণ উন্নয়ন খাতে শুধু লুটপাট হয়।”
করোনামহামারীর মধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবিত বাজেটের মধ্যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেওয়ার কঠিন পরিকল্পনা সাজিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশের মত।