করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে বিধিনিষেধ তুলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্যই ওই সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হয়েছে।
রোববার সংসদে তিনি বলেন, “এটা তো বাস্তবতা, করোনার ভয়ে তো আমরা মানুষকে না খাইয়ে মারতে পারি না। তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থাটা আমাদের নিতে হবে।”
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখার পাশাপাশি ভাইরাস থেকে মানুষের সুরক্ষার জন্য এলাকাভিত্তিক ‘লকডাউন’ করার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “কোন কোন এলাকায় বেশি (সংক্রমণ) দেখা যাচ্ছে, সেখানে লকডাউন করে তা আটকাচ্ছি। যাতে ওখান থেকে সংক্রমিত না হয়।”
সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহর মৃত্যুতে সংসদে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস সঙ্কট এবং সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছিল ৭২ বছর বয়সী নাসিমের। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শনিবার সকালে মারা যান আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য।
আর ‘হার্ট অ্যাটাক’ হলে শনিবার রাতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহকে ঢাকা সিএমএইচে নেওয়া হয়। সেখানে রাত পৌনে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। পরে নমুনা পরীক্ষায় জানা যায়, তিনি করোনাভাইরাসেও আক্রান্ত ছিলেন।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মোহাম্মদ নাসিম ও শেখ আব্দুল্লাহর অবদানের কথা স্মরণ করেন। সেই সঙ্গে দলের ক্রান্তিকালে পাশে থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সঙ্কটের প্রভাব নিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “যখন আমরা একটি কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, দেশের দারিদ্রসীমা আমরা কমিয়ে এনেছিম দারিদ্রসীমা মাত্র ১০ বছরে ৪০ ভাগ থেকে আমরা ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের জিডিপি বেড়ে গিয়েছিল। আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছিলাম।
“আমাদের আশা ছিল মুজিববর্ষ উদযাপন করব। কিন্তু এ সময় এক অদৃশ্য শক্তি, করোনাভাইরাস যা কেউ চোখে দেখতে পারে না, বুঝতেও পারে না… সারা বিশ্বটাকে স্থবির করে দিল, সারাবিশ্বে যেন কেমন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করল।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটা আতঙ্ক-ভয়-ভীতি, মৃত্যু আতঙ্ক যেন সারা বিশ্বকে পেয়ে বসেছে। এটাই হচ্ছে অদ্ভুত ব্যাপার। এ ধরনের পরিবেশ আগে আমরা আর কখনো দেখিনি।”
এই সঙ্কটের মধ্যে সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়েও নিষেধ শুনতে হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজকে আমি সংসদে আসব, কিন্তু আমাকে অনেক জায়গা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। ভীষণভাবে বাধা দেয়া হয়েছে, ‘না না আপনি যাবেন না, নেত্রী যাবেন না’।
“আমি বললাম গুলি, বোমা, গ্রেনেড কত কিছুইতো মোকাবেলা করে করে এ পর্যন্ত এসেছি। এখন কী একটা অদৃশ্য শক্তি তার ভয়ে ভীত হয়ে থাকব আর পার্লামেন্টের মেম্বার, আমাদের আওয়ামী লীগের পরিবারের একজন সংসদ তাকে হারিয়েছি আর আমাদের কেবিনেট সদস্য একজন- তাকে হারালাম আর সেখানে আমি যাব না! এটা তো হয় না।”
করোনাভাইরাস যে পুরো বিশ্বকেই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে, সে কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এই আতঙ্কটা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যেটা সত্যি খুব দুঃখজনক।… এখানে উন্নত দেশ, অনুন্নত দেশ বা উন্নয়নশীল দেশ… অস্ত্রের দিক থেকে শক্তিশালী, অর্থের দিক থেকে শক্তিশালী অথবা হয়ত দরিদ্র রাষ্ট্র- কোনো ভেদাভেদ নেই। সব যেন এক হয়ে গেছে এক করোনাভাইরাসের ভয় এবং আতঙ্কে। সব জায়গায় কিন্তু একই অবস্থা।”
ভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষকে বোঝাতে যে আপনারা অন্তত একটু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। এটা খুব সাংঘাতিক একটা সংক্রামক ব্যাধি। এই সংক্রমণটা যাতে না হয়। সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য দেশবাসীকে বলছি।”
দুই মাসের লকডাউনের পর এখন করোনাভাইস মোকাবিলায় সরকারের কৌশল ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জীবনযাত্রা যাতে চলে, সেই ব্যবস্থা তো করতে হবে। আমরা ঠিক করেছি, কোন কোন এলাকায় বেশি দেখা যাচ্ছে সেটা লকডাউন করা। সেটা আমরা আটকাচ্ছি। সেখান থেকে যেন সংক্রমণ না হয়।
“সাথে সাথে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলি যেন সচল থাকে সেদিকে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা একটা বাজেটও দিতে সক্ষম হয়েছি। এই কাজগুলো যখন করছি সেটা এক ধরনের যুদ্ধ। সেই সময় যাদের আমরা সবসময় কাছে পেয়েছি তাদের দুজনকে হারানো অত্যন্ত কষ্টকর।”
নেতাকর্মীদের মৃত্যুতে পাশে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগের ‘ঐতিহ্য’, কিন্তু এই সঙ্কটের সময়ে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমরা আওয়ামী লীগের যে কোনো একজন কর্মী মারা গেলে ছুটে গিয়েছি। জানাজায় অংশ নেওয়া, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো, পরিবারের সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু এখন এমন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ, সেটা আর করতে পারছি না। পরিবারের সদস্যদের সাথে একটু দেখা করা, তাদেরকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া, সেই সুযোগটা পেলাম না কেন, এটা সব থেকে কষ্টকর।”