করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সবচেয়ে জরুরি সন্দেহভাজনের দ্রুত পরীক্ষা ও তাকে আলাদা করার যে পরামর্শ বিশেষজ্ঞরা দিয়ে আসছেন, সেখানে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।
সংক্রমণ বাড়তে থাকার মধ্যে পরীক্ষার চাপ বাড়লেও সে তুলনায় পরীক্ষার সুযোগ বাড়ছে না। ফলশ্রুতিতে পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে একটি বড় অংশ, আর যাদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে তাদের অনেকেরই ফল পেতে লাগছে কয়েক দিন। এমন ঘটনাও ঘটছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা জানার আগেই কারও কারও মৃত্যু ঘটছে, আবার অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে ৬২টি গবেষণাগারে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। তবে এসব গবেষণাগারে জনবল ও উপকরণ সঙ্কটে সক্ষমতার চেয়ে কম নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। ফলে গবেষণাগারগুলোতে জমছে নমুনার সারি।
এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষার জন্য গবেষণাগার বাড়ানো এবং জনবলসহ অন্যান্য উপকরণ বাড়িয়ে বিদ্যমান গবেষণাগারের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বিদ্যমান গবেষণাগারের সক্ষমতার পুরোটাই ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন তারা পিসিআর টেস্টের বাইরে গিয়ে অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মতো বিকল্প নিয়ে ভাবছেন।
বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা হয় গত ২১ জানুয়ারি। প্রথম দিকে শুধু আইইডিসিআরে পরীক্ষা করা হলেও সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গবেষণাগার বাড়ানো হয়। এখন দিনে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭১৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
জনসংখ্যার হিসাবে নমুনা পরীক্ষার এই হারে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজনের তুলনায় বলে অভিমত দিয়ে গেছেন করোনাভাইরাস সংক্রমণে লাগাম টানতে ঢাকা সফর করে যাওয়া চীনা বিশেষজ্ঞ দলও।
এদিকে নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে হয়রানি ও ফল পেতে বিলম্বের কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
এদেরই একজন রাজধানীর মাতুয়াইলের বাসিন্দা আফরোজা মুক্তা জানান, তার বাবা অসুস্থ্ হলে চিকিৎসক কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে বলেন। কিন্তু কয়েক জায়গায় ঘুরেও নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছিলেন না। অনেক ঘোরাঘুরির পর ১৩ জুন আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসেন। তবে রিপোর্ট হাতে পান চার দিন পর।
“ওই চারটা দিন কেমন ছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। রিপোর্ট পাচ্ছি না। রিপোর্ট ছাড়া অনেক চেষ্টা করেছি ভর্তি করানোর জন্য। যে মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছি, আমরা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আব্বা কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন। তবে আল্লাহর রহমতে একটু ভালো আছেন।”
বরগুনার একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা নেসার উদ্দিনের কোভিড-১৯ উপসর্গ দেখা দিলে গত ৯ জুন বরগুনা সদর হাসপাতালে নমুনা দেন তিনি। ১৩ জুন রাতে তাকে জানানো হয়, তার নমুনা নষ্ট হয়ে গেছে। পরে ১৬ জুন আবার নমুনা দেন। ১৯ তারিখ তাকে জানানো হয়, এবারের নমুনাও নষ্ট হয়ে গেছে।
“এত দিনে একটা রিপোর্ট পাইনি৷ করোনা পরীক্ষার ফলাফল না জানায় কাজে যোগ দিতে পারছি না। আবার নমুনা নেবে কি না সেটাও জানাচ্ছে না।”
চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর পর করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল পজিটিভ এসেছে, যাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাও রয়েছেন।
আবার পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়ার বেশ কয়েক দিন পর কিছুটা সুস্থ বোধ করায় অন্য জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে ‘নেগেটিভ’ ফল আসার পরে প্রথম পরীক্ষার ফল ‘পজিটিভ’ আসার কথা জানা গেছে।
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ফাতেমা বেগম করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনটি হাসপাতাল ঘুরে তাকে ভর্তি করা হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষার পর সংক্রমণ ধরা পড়লে তাকে মঙ্গলবার নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
মো. মেহেদি হাসান নামের যাত্রাবাড়ীর একজন বাসিন্দা মঙ্গলবার বলেন, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় গত ১০ জুন যাত্রাবাড়ীর ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে স্থাপিত নমুনা সংগ্রহ বুথে নমুনা দেন তিনি। বেশ কয়েক দিনেও পরীক্ষার ফল না আসায় তিনি সেখানে খোঁজ নিতে যান।“তখন ওখান থেকে বলা হয়, রিপোর্ট আসতে সপ্তাহখানেক লাগে। আবার কারও কারও বেলায় ১৪ দিনও লেগে যায়। এদিকে অফিস থেকে বার বার তাড়া দিচ্ছিল। এরমধ্যে উপসর্গগুলোও কমে আসছিল। তাই ১৬ জুন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে গিয়ে আবার নমুনা দেই। ওই দিন রাতেই আমার রেজাল্ট আসে নেগেটিভ। এদিকে গতকাল রাতে প্রথম পরীক্ষার ফল এসএমএসে এসেছে পজিটিভ। এখন সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আগামীকাল আবার নমুনা দেব।”
বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনরাও করোনাভাইরাস নমুনা পরীক্ষার চাপ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন। তবে সক্ষমতার অভাবে সময়মতো পরীক্ষার ফল জানানো যাচ্ছে না বলেও তারা স্বীকার করেছেন।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, তারা প্রতিদিন ২০০টি নমুনা খুলনা মেডিকেল কলেজের আরটিপিসিআর ল্যাবে পাঠান। যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা থেকে নমুনা আসে। মেডিকেল কলেজের সংগ্রহ করা মিলিয়ে পাঁচশর মতো নমুনা হয়।
তিনি বলেন, এই সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা খুলনা মেডিকেল কলেজের নেই। ফল দিতে দেরি হয়। নমুনা পরীক্ষায় গতি আনতে আরও দুটি আরটিপিসিআর মেশিন প্রয়োজন।
“একজন রোগী শনাক্ত হলে তার কন্টাক্টের আরও পনেরো থেকে বিশটা নমুনা নিতে হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী পাঠাচ্ছে পরীক্ষা করার জন্য। আমরা খুব বিপদের মধ্যে আছি বলা যায়।”
ডা. সুজাত জানান, “খুলনা মেডিকেলের ল্যাব প্রতিদিন তিনটা রান করে (প্রতিবার ৯৬টি নমুনা দিয়ে আরটিপিসিআর মেশিন চালু করা হয়)। এভাবে সারা দিন চালালেও এত নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব না। এজন্য আমাদের এখানে আরও দুটি আরটিপিসিআর মেশিন দরকার।”
ঢাকার পাশের একটি জেলার একজন সিভিল সার্জন জানান, ওই জেলায় প্রতিদিন ২০০টি নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠান। তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণের দিক দিয়ে উপরের দিকে থাকা এই জেলায় আরও বেশি নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন।
“নমুনা দেওয়ার জন্য লোকজনের চাপ আছে। কিন্তু আমাদের এত নমুনা নেওয়ার সক্ষমতা নেই। এ কারণে কোনো উপসর্গ না থাকলে আমরা নমুনা নিচ্ছি না। তবে এতেও সমস্যা থেকে যায়, অনেকের উপসর্গ না থাকায় তাদের শনাক্ত করা যায় না।”
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান জানান, কিশোরগঞ্জেও এখন প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিনশ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে প্রতিদিনই এ চাপ বাড়ছে।
তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জের একটি গবেষণাগারে প্রতিদিন এক পালায় ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা হয়। বাকিগুলো ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
“ঢাকায় পাঠালে দুই-তিন দিন, আবার পাঁচ থেকে সাত দিন সময়ও লাগে। জনবল কম থাকায় দুই শিফটে পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। আমরা বলেছি জনবল দেওয়ার জন্য।”
নমুনা পরীক্ষা নিয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, শুরুতে একটা পরীক্ষাগার থেকে এখন ৬২টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে- এটা ইতিবাচক। তবে এখনও নমুনা পরীক্ষায় সঙ্কট রয়েছে।
“সেটা আরও বাড়াতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। অনেক গবেষণাগার শুক্র-শনিবার বন্ধ থাকে। সক্ষমতা অনুযায়ী পরীক্ষা হয় না। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বাড়াতে হবে। কিন্তু এত চিল্লাচিল্লি করার পরও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ করা হয়নি।
“দ্বিতীয়ত হল টেস্টিং কিটসহ লজিস্টিকসের অব্যাহত সরবরাহ। লোকবল এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ যদি বেশি থাকে তাহলে কয়েকটি শিফটে কাজ (নমুনা পরীক্ষা) করা যাবে।”
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. সহিদ উল্লাহও একই অভিমত দেন।
তিনি বলেন, “ভালোভাবে চেষ্টা করলে ২৮ ঘণ্টার মধ্যে একজনের ফলাফল দেওয়া সম্ভব। কিন্তু এখন দুই দিন, তিন দিন চার দিনও লেগে যাচ্ছে। আমাদের যে আরটিপিসিআর মেশিন আছে তাতে প্রতিদিন ১০০, ২০০ বা ৩০০ নমুনা পরীক্ষা করছে। এখানে কিছু লজিস্টিকস সাপোর্ট দিলে তখন যে ল্যাবটা এখন ১০০টি নমুনা পরীক্ষা করতে পারে সে হয়ত আরও ৫০টি নমুনা বেশি পরীক্ষা করতে পারল।
“এখন পর্যন্ত আমার যা মনে হচ্ছে জনবল এবং ল্যাবের সক্ষমতা বাড়াতে যেসব লজিস্টিকস লাগে সেগুলো বাড়াতে হবে। এখন বিদ্যমান আরটিপিসিআর মেশিন দিয়েই এখনকার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ নমুনা পরীক্ষা করতে পারব।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে কাজ করছেন তারা। তবে চাইলেই একসঙ্গে অনেকগুলো নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না।
“ল্যাবগুলো তাদের সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি ব্যবহার করছে। এই ক্যাপাসিটিতে এর চেয়ে বেশি টেস্ট করা সম্ভব না। এ কারণে আমরা ল্যাব বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এছাড়া পিসিআর ছাড়াও আরও নতুন পদ্ধতিতে টেস্ট প্রবর্তনের চেষ্টা করছি। সেটা অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি টেস্ট হতে পারে।”
রেফারেন্স ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, সংক্রমণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ১৭ নম্বরে। তবে নমুনা পরীক্ষায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। বাংলাদেশে প্রতি দশ লাখে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে ৩ হাজার ৮৩১টি।
২৩ জুনের হিসাবে নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি দশ লাখ মানুষের মধ্যে ৮৭ হাজার ৬৬৪ জন, ব্রাজিলে ১১ হাজার ৮১৪ জন, রাশিয়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৪৭৭ জন, ভারতে ৫ হাজার ১৭৩ জন, যুক্তরাজ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার ২৯৬ জন, স্পেনে ১ লাখ ১০ হাজার ৪২৬ জন, পেরুতে ৪৬ হাজার ৫৪ জন, ইতালিতে ৮২ হাজার ৯১৫ জন, চিলিতে ৫১ হাজার ৩৯৯ জন, ইরানে ১৭ হাজার ২৬২ জন, জার্মানিতে ৬০ হাজার ৩৬ জন, তুরস্কে ৩৫ হাজার ৪২২ জন, পাকিস্তানে ৫ হাজার ১০৪ জন, ফ্রান্সে ২১ হাজার ২১৪ জন এবং সৌদি আরবে ৩৭ হাজার ৮৮২ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে।
আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলাদেশের আগে থাকা দেশগুলোর মধ্যে মেক্সিকো বাংলাদেশের চেয়ে কম নমুনা পরীক্ষা করেছে। মেক্সিকো প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ৩ হাজার ৭৯০ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে।