আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কখনোই অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পাননি নাসির হোসেন। অথচ আমিনুল ইসলামের মতে, নাসির অনেকবারই ছিলেন দলের নেতা! মাঠে যতটা প্রাণবন্ত ও চটপটে থাকতেন তিনি, যেভাবে উজ্জীবিত করতেন সবাইকে, তাতে তাকেই আমিনুলের মনে হতো ফিল্ডিংয়ের অধিনায়ক। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে অধিনায়ক ও অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ানের মতে, দেশের সবসময়ের সেরা ফিল্ডার নাসিরই।
আমিনুলের অকপট স্বীকারোক্তি, তাদের সময়ে এখনকার মতো এতটা গুরুত্ব পেত না ফিল্ডিং। সেই সময় ফিল্ডিংয়ের মানও ছিল না ততটা ভালো। ফিল্ডিংয়ে আমিনুলের পছন্দের তালিকায় বেশি থাকল তার পরের কয়েক প্রজন্মের ফিল্ডারদের কথা।
আমিনুলদের সময়ের চেয়ে গুরুত্ব বাড়লেও বাংলাদেশের সার্বিক ক্রিকেট সংস্কৃতিতে ফিল্ডিং এখনও তুলনামূলক অবহেলিত। ব্যাটিং-বোলিংয়ের তুলনায় ফিল্ডিং নিয়ে আলোচনাও কম। ধারাবাহিক আয়োজনে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ফিল্ডার। দেশের বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটাররা জানাচ্ছেন তাদের ভাবনা। তিনটি ক্যাটাগরিতে আলাদাভাবে সেরার পাশাপাশি বাছাই করা হচ্ছে সার্বিকভাবে সেরা। আয়োজনের ত্রয়োদশ পর্বে আমিনুল জানালেন তার ভাবনা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে প্রায় ১৫ বছর খেলেছেন আমিনুল। নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশকে। খেলোয়াড়ি জীবন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেননি কখনও। খেলা ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন কোচিংয়ে, সেখানেও ঘরোয়া ক্রিকেটে পেয়েছেন সাফল্য। পরে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে অনেক দিন কাজ করে এখন দায়িত্ব পালন করছেন আইসিসি ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে। তবে দেশের বাইরে থেকেও নিয়মিত অনুসরণ করেছেন দেশের ক্রিকেটকে। মাঠের ভেতরে-বাইরে থেকে দেখার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জানালেন তার চোখে দেশের সেরা ফিল্ডারদের কথা।
স্লিপে:
“স্লিপে আমি তিন জনের নাম বলব, হাবিবুল বাশার সুমন, জুনায়েদ সিদ্দিক ও ইমরুল কায়েস।”
“স্লিপে খুব ভালো ফিল্ডার আমরা পাইনি নানা বাস্তবতায়। আমাদের সময়ে তো ঘরোয়া ক্রিকেটে স্লিপে বল যাওয়াই ছিল কঠিন। আমি তাই স্লিপের ক্ষেত্রে টেস্ট যুগের ফিল্ডারদেরই প্রাধান্য দিয়েছি বেশি।”“ওরা তিন জনই ভালো। তবে আমি এগিয়ে রাখছি সুমনকে। খুব নিরাপদ স্লিপ ফিল্ডার ছিল সে। পেস-স্পিন দুটিতেই স্বচ্ছন্দ ছিল। জুনায়েদ ও ইমরুলও নিরাপদ। তবে সুমনকে আমি এগিয়ে রাখছি দুটি কারণে। প্রথমত, লম্বা সময় ধরে কাজটা করেছে। আর কেউ মনে হয় এতদিন টানা স্লিপে ফিল্ডিং করেনি। দ্বিতীয়ত, ওর ওপর চাপ ছিল অনেক। অধিনায়কত্ব করেছে অনেক দিন, অনেক কিছু সামলাতে হয়েছে। মাঠের অনেক দিক দেখতে হয়েছে। এত কিছু মাথায় নিয়েও স্লিপে ফোকাস ধরে রেখেছে সে।”
৩০ গজ বৃত্তে:
“এখানেও শুরুতে তিন জনের নাম বলে নিচ্ছি, আফতাব আহমেদ, নাসির হোসেন ও সাব্বির রহমান।”
“তিন জনই খুব ভালো। গতিময়, রিফ্লেক্স ভালো, নিরাপদ হাত ছিল সবার। আফতাবের একটা বিশেষত্ব ছিল থ্রোয়িং, অল্প জায়গা থেকে দ্রুত থ্রো করতে পারত। সাব্বিরও বৃত্তের ভেতরে সব মিলিয়ে ভালো। তবে তিন জনের মধ্যে আমার কাছে সেরা নাসির।”
“নাসিরকে এগিয়ে রাখার কারণ তিনটি জায়গায় ওর প্রায় সমান দক্ষতা, পয়েন্ট, স্কয়ার লেগ ও কাভার। পয়েন্টে বল অনেক জোরে আসে, বিশেষ করে নতুন বলে। চোখ খুব ভালো হতে হয় এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলে চোখ রাখতে হয়। স্কয়ার লেগে দাঁড়ালে বল দেখার সময় মেলে খুব কম। ব্যাটসম্যানের শরীরের কারণে বল একটু দেরিতে চোখে পড়বে। কাজেই খুব দ্রুত রিঅ্যাক্ট করতে হয়। আর কাভারে নিজের আশেপাশের অন্তত ৬ থেকে ৮ ফুট জায়গার দখল নিতে হয়।”“তিন জায়গাতেই প্রায় সমান দক্ষতা দেখানো বেশ বিরল। আফতাব ও সাব্বির যেমন তিন জায়গায় সমান নয়। কিন্তু নাসির সব জায়গাতেই এক্সট্রা অর্ডিনারি।”
সীমানায়:
“বাউন্ডারিতে আমাদের সময় এনামুল হক মনি ভাই খুব ভালো ছিলেন। ক্যাচিংয়ে নির্ভরযোগ্য, থ্রোয়িংও ভালো ছিল। মোহাম্মদ রফিক ভালো ছিল। তবে আমার কাছে সেরা তামিম ইকবাল।”
“বাউন্ডারিতে ফিল্ডিংয়ে থ্রোয়িং অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমি বেশি গুরুত্ব দেই ক্যাচিংকে। কারণ এখানে ক্যাচিং খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বিশেষ কিছু মুহূর্তে উঁচু বা লম্বা ক্যাচ নেওয়া অনেক চাপের ব্যাপারও। ফিল্ডারের স্কিল ও নার্ভের বড় পরীক্ষা এটা। ক্যাচিংয়ের কারণেই আমার কাছে এগিয়ে তামিম।”
“অসাধারণ সব ক্যাচ তামিম নিয়েছে। অনেকগুলো এখনও আমার চোখে ভাসছে। আমার মনে হয়, বোলাররা ওকে বাউন্ডারিতে দেখলে নিরাপদ বোধ করে।”
সব মিলিয়ে সেরা:
“এখানে আসলে খুব বেশি ভাবার প্রয়োজন নেই আমার। কোনো সংশয় ছাড়াই সেরা নাসির হোসেন।”
“বৃত্তের ভেতরে ওর বিশেষত্ব তো আগেই বলেছি। বৃত্তের বাইরে, মাঠের যে কোনো জায়গায় সে দারুণ। ক্যাচিং, রানিং, থ্রোয়িং, ডাইভিং, সব ভালো। ক্যাচ নেওয়া, রান আউট করা, রান বাঁচানো, সব পারে সে। সব মিলিয়ে নাসির ফিল্ডিংয়েও অলরাউন্ডার।”
“আরও কিছু ব্যাপার আছে। মাঠে খুব প্রাণবন্ত ও চটপটে সে। সবাইকে চাঙা রাখতে পারে। দারুণ আত্মবিশ্বাসীও। নিজের দিনে নাসিরকে আমার মনে হতো, ফিল্ডিংয়ের অধিনায়ক। অন্য সব ফিল্ডারকেও সহায়তা করত। ফিল্ডিংয়েও কিন্তু টিমম্যান হতে হয়। নাসির সেটা ছিল। সার্বিক ফিল্ডিংয়ে যতটা অবদান রাখত, সেজন্যই নাসির সেরা।”