একটি চিঠি বদলে দিল দৃশ্যপট

image-327163-1595090142

শেখ হাসিনা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তার আরেকটি বড় পরিচয়, তিনি দেশের সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যবাহী ও গণমানুষের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি।

সবকিছু ছাপিয়ে শেখ হাসিনার বড় পরিচয় তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার; তার আদর্শের ঠিকানা ও আশ্রয়স্থল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
বাঙালির রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু, বাঙালির স্বপ্নের সারথি বঙ্গবন্ধু। তাকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়া হয়। ইতিহাসের রথ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম নানাভাবে মুছে দিতে সচেষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর অবদানকেও অস্বীকার করতে শুরু করে তারা।

সেনাছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে খাকি পোশাক আর ভারি বুটের দাপটে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু হয় সেই থেকেই। একইসঙ্গে রচিত হয় গণতন্ত্রের কবর। মানুষ হারিয়ে ফেলে ভোট ও ভাতের অধিকার চিরতরে।

এমনই এক উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন যাত্রার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশকে এক সোনালি গন্তব্যে পৌঁছে দিতে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি ফিরলেন তার বাবার হাত ধরে জন্ম নেয়া প্রিয় সবুজ-শ্যামল বাংলার বুকে।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি যেমন সেদিন বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার আশায় আকুল ছিল, তেমনি বাঙালির জীবনের দ্বিতীয় সোনালি অধ্যায় ছিল শেখ হাসিনার দেশে ফেরার দিন।

কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী, মজুর, সাধারণ খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ থেকে শুরু করে গণতন্ত্রকামী জনতা যেন তার দেশে ফেরার জন্যই উন্মুখ হয়েছিল।

দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা হাল ধরেন পিতার হাতে গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের। জাতির চরম দুঃসময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান তিনি গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে।

আর এ পথটি যে বড্ড কঠিন পথ- তা এদেশে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে বেশি মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনিই সবচেয়ে বেশি ভালো জানেন- কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তাকে আজকের এ জায়গাটিতে আসতে হয়েছে।

ঘরে-বাইরে হাজারও প্রতিকূলতা তো ছিলই; ছিল মৃত্যুভয়, ছিল বুলেটের তাড়া- তবুও সামরিক জান্তার পতন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছিলেন আপসহীন। ছিলেন স্বাধীনচেতা, দৃঢ় এবং অনমনীয়।

বিশেষ করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়াটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে অকল্পনীয় অধ্যায়। আল্লাহর অশেষ রহমত এবং মানুষের দোয়ায় তিনি সেদিন নতুন করে জীবন ফিরে পান।

দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নব্বইয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়; কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাও বারবার অশুভ শক্তির থাবায় বাধাগ্রস্ত হয়।

আবার তিনিই কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন- গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে, ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করে জাতিকে সঠিক পথে, আলোর পথে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দিন শেষে আলোর দিশারি তিনিই।

দীর্ঘ এ পথ চলায় বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর বারবার আঘাত আসে। জীবনের ওপর আঘাত তিনি কখনই আমলে নেননি। মৃত্যুভয় কখনই তিনি করেননি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ২০০৭ সালে। এক-এগারোর সরকারের সময় তার ওপর আসা আঘাত ছিল একাধারে তাকে রাজনীতি থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানোর পাশাপাশি দেশের মানুষের ওপর খাকি পোশাকের রাজত্ব স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।

ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ওই সময়ের সরকারকে অনেকে বেসামরিক সরকার বললেও আসলে এ সরকারটিও ছিল সামরিক সরকার। সেনাছাউনি থেকে ভিন্নরূপে, ভিন্ন আবহে পরিচালিত হতো এ সরকার।

ক্ষমতায় এসেই ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন এক-এগারোর সরকার বিরাজনীতিকরণে নেমে পড়ে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর আক্রোশটাই যেন ছিল তাদের বেশি।

তাকে রাজনীতি থেকে দূরে পাঠাতে পারলেই যেন সামরিক সরকারের এদেশের জনগণের ওপর চিরতরে জেঁকে বসার কাজটি খুব সহজ হয়। তাই তাদের সব আক্রোশ এবং আক্রমণের প্রথম শিকার ছিলেন জননেত্রী, গণমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা।

আমি তখন তার প্রেস সেক্রেটারি। ওই সময়ের ঘটনাবলি খুব কাছে থেকে দেখেছি। আমার এখনও মনে আছে, নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) তার ধানমণ্ডির বাসভবন সুধা সদন থেকে গ্রেফতার এবং জেলে পাঠানোর ঘটনাপ্রবাহ।

দিনটি ছিল ১৬ জুলাই। সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও তাকে গ্রেফতারে প্রস্তুতি ছিল পুরো সপ্তাহজুড়ে।

আগের দিন ১৫ জুলাই রাত ১১টা পর্যন্ত আমি সুধা সদনে নেত্রীর সঙ্গে ছিলাম। রাত বেশি হতেই তিনি আমাকে বাসায় চলে যেতে বললেন। বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে; তুমি বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও।’

আমি তার কথামতো আমার গেণ্ডারিয়ার বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। রাত সাড়ে ১১টা বাজতেই সেই সময়ের উপসম্পাদক সাইফুল আলমের ফোন। এখন তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি।

সাইফুল আলম আমাকে বললেন, ‘আজাদ ভাই, কোথায় আপনি? সুধা সদনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আপাকে (শেখ হাসিনা) আজ রাতেই অথবা ভোরে গ্রেফতার করা হতে পারে।’

খবরটা শুনে আমি বিচলিত হলাম। যদিও আমরা আগে থেকেই জানতাম, যে কোনো সময় নেত্রীকে গ্রেফতার করা হবে। প্রতিদিনই তাকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি চলছিল- এ খবরটা আমাদের জানাই ছিল।

নেত্রীও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। বঙ্গবন্ধুর রক্ত তার ধমনিতে। তিনি এসবে একটুও ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন না; বরং গ্রেফতারের প্রসঙ্গ উঠলেই নেত্রী আমাদের বলতেন, ‘যা হওয়ার হবে। আমি কোনো অন্যায় করিনি।’

সে যাই হোক, সাইফুল আলমের ফোন নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিল। তার কাছ থেকে খবরটা পেয়ে আবার সুধা সদনের দিকে রওনা দিলাম।

পথে ওই বাসায় থাকা নেত্রীর নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) ইকবালসহ কয়েকজন ব্যক্তিগত স্টাফকে ফোন দিলাম। খবরাখবর নিলাম। তাদের কাছে অবশ্য বাইরের খবর নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি চলে এলাম; কিন্তু সুধা সদনে যাওয়ার পথেই বাধার সম্মুখীন হলাম।

দেখলাম, চারদিকে কাঁটাতারের ব্যারিকেড বিছিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাসহ সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমি দেখলাম, পথে পথে কেবল পুলিশ, বিডিআরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য।

কয়েকজনকে অনুরোধ করলাম, নিজের পরিচয় দিলাম; কিন্তু লাভ হল না। তাদের বাধায় সুধা সদনের কাছাকাছিও যেতে পারলাম না; ধানমণ্ডি ৫ নম্বরের শেষ মাথায় গিয়ে অবস্থান নিলাম। সেখানে গণমাধ্যমকর্মীরাও একে একে কেবল আসতে শুরু করেছেন।

সব পথ বন্ধ। ফোনেই এর-ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কথা বললাম। এরই মধ্যে সুধা সদনে ছুটে এলেন নেত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী।

এ অবস্থায় রাত ২টা পর্যন্ত রাস্তায় কেটে গেল। ক্লান্ত হয়ে, বিষণ্ন মনে ফিরলাম গেণ্ডারিয়ার বাসায়। ওই রাতে আর ঘুম হল না। চোখ টেলিভিশনের পর্দায়।

বিএনপি নেতা ও যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিএসবি’ পুরো ঘটনাপ্রবাহ লাইভ সম্প্রচার করছে। আমার চোখ সেদিকেই।

১৬ জুলাই ভোর থেকেই নেত্রীকে গ্রেফতারের আনুষ্ঠানিক পর্ব শুরু হল। এ আরেক কালো অধ্যায় বাঙালির জীবনে। ভোর ৫টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা সুধা সদনে প্রবেশ করেন। তারা নেত্রীকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করলেন।

নেত্রী তাদের চা-নাস্তা দিতে বললেন তার বাসার স্টাফদের। এরই মধ্যে তিনি নিজেও তৈরি হলেন। নামাজ পড়লেন। কোরআন শরিফ পড়লেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে তার সুধা সদনের বাসায় অবস্থান করা নাতি টুটুলের কাছে দিয়ে বললেন, এটি যেন সে আমাকে পৌঁছে দেয়।

এ চিঠির বিষয়ে কিছু বলার আগে আরও একটি বিষয় বলে নেয়া দরকার। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সেদিন গ্রেফতারের নামে যে নৈরাজ্যকর পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল, তা ছিল নজিরবিহীন।

সাবেক সফল প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হবে; তবে এ গ্রেফতার নিয়ে এত টানাহেঁচড়া, জবরদস্তি এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করার বিষয়টি ছিল সত্যিই দুঃখজনক ও অত্যন্ত দৃষ্টিকটু।

আজও আমার মাথায় এ প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে- কেন এভাবে তাকে গ্রেফতার করা হল? আসলে এ ধরনের একটি ভীতিকর, বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করে, জবরদস্তি করে পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল; কিন্তু যারা এ কাজটি করলেন, তারা ভুলে গেলেন- শেখ হাসিনা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি ভয় পাওয়ার মেয়ে নন। মাথা নোয়াবার মেয়ে শেখ হাসিনা নন।

গ্রেফতারের পর বাসা থেকে পুরান ঢাকায় আদালতে নেয়া হয় নেত্রীকে। আমিও ওখানে ছুটে গেলাম। ওখান থেকে নেত্রীকে সংসদ ভবনের সাব জেলে নেয়া হয়। আমি চলে আসি জাতীয় প্রেস ক্লাবে।

প্রেস ক্লাবও তখন অবরুদ্ধ। চারদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে লাউঞ্জে বসে টেলিভিশন দেখছি। বিশেষ করে সিএসবি। আগেই বলেছি, এ চ্যানেলটি লাইভ সম্প্রচারের নামে তখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিদ্বেষমূলক খবর প্রচার করছিল।

তিনি ব্যর্থ, দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য- এসব প্রমাণে মরিয়া ছিল। এতে অবশ্য লাভই হয়েছিল বলে মনে হয় আমার। দেশের অগণিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী জানতে পারছিলেন, তাদের প্রিয় নেত্রীর ওপর দিয়ে কী ভয়াবহ ঝড় যাচ্ছে।

সামরিক লেবাসের ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকার আসলে কী চায়, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল প্রিয় নেত্রীকে এভাবে গ্রেফতারের প্রতিটি পর্ব দেখে।

যদিও আওয়ামী লীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ চেয়েছিল, শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হোক। তাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানো হোক। এতে করে হয়তো তাদের ভাগ্য খুলবে- এ আশায় তারা হাত মিলিয়েছিল এক-এগারোর সরকারের সঙ্গে।

যদিও তাদের আশা পূরণ হয়নি। এক-এগারোর সরকার নয়; বরং এ ক্ষুদ্র অংশটিকে পরবর্তীতে ক্ষমা করে দিয়ে শেখ হাসিনাই তাদের দলে এবং সরকারে পুরস্কৃত করেছিলেন, মূল্যায়ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদারতা এমনই।

ওই সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে ‘মাইনাস টু’ নামে একটি ফর্মুলার কথা নানাভাবে প্রচার করেছিল এক-এগারোর সরকার।

আসলে এ ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় ছিল বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি দেশ থেকে চিরতরে আবারও নির্বাসনে পাঠানো। দেশের মানুষের ওপর সামরিক জান্তাকে আবারও চিরতরে বসিয়ে দেয়া।

ওই সময় বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেল ছিল বিএনপি সমর্থক, বিএনপি নেতাদের মালিকানাধীন। তারা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে ‘মাইনাস’ করার ফর্মুলা বাস্তবায়নে নেমে পড়েছিল পুরোদমে।

প্রিন্ট মিডিয়ারও কোনো কোনো সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিক ছিলেন তখন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সফল হননি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বরং ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ভালোবেসেছেন, তার মুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। দিন শেষে শেখ হাসিনার মুক্তি এবং বিজয় নিশ্চিত করেছেন।

অবশ্য এর পেছনে একটি চিঠি, একটি ভাষণ বারুদের মতো কাজ করেছে। শেখ হাসিনার একটি চিঠি পুরো দৃশ্যপট বদলে দিয়েছিল তখন।

আমি আগেই বলেছি, সুধা সদন থেকে গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে নেত্রী আমাকে দেয়ার জন্য একটি চিঠি লিখেছিলেন। মূলত এটি ছিল দেশবাসী এবং দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেয়া তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য।
আমি যেহেতু প্রেস সেক্রেটারি; তাই তিনি তার নাতি টুটুলকে বলেছিলেন এটি আমার হাতেই দিতে। খামবদ্ধ এ চিঠিতে কী আছে, আমি জানতাম না। টুটুলও না।

আদালত থেকে আমি প্রেস ক্লাবে আসার কিছুক্ষণ পর, সাড়ে ১০টার দিকে টুটুল ফোন করে জানায়, আমার জন্য একটি চিঠি লিখে রেখে গেছেন নেত্রী। আমি কীভাবে নেব, তা জানতে চাইল টুটুল। আমি জবাবে ওকে বললাম, একটু অপেক্ষা করতে। কীভাবে নেব জানাব।

এর কিছুক্ষণ পর ফোন করলেন প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ। নেত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তিনি সবার কাছে। বেবী মওদুদ বললেন, ‘চিঠি আমার কাছে। টুটুলের কাছ থেকে আমি নিয়ে আসছি। তুমি এসে নিয়ে যাও।’
আমি একটু রেগেই গেলাম এ খবর শুনে। তাকে বললাম, ‘নেত্রী চিঠিটা আমাকে দিতে বলেছেন। আপনি কেন নিলেন?’ এ নিয়ে আরও কিছু কথা হল। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন।

এরপর জনকণ্ঠের সিনিয়র সাংবাদিক দুলাল ভট্টাচার্যকে দিয়ে চিঠিটা প্রেস ক্লাবে আমার উদ্দেশে পাঠিয়ে দিলেন। দুপুর ১টার মধ্যে চিঠি আমার হাতে এলো। কাউকে কিছু না বলে খাম খুলে ভেতরের কাগজটি বের করলাম। দেখলাম, গ্রেফতারের আগে দেশবাসীকে উদ্দেশ করে লেখা নেত্রীর একটি বক্তব্য।

কী করব, ভাবলাম। জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনামলের সময় দেখেছি- এ ধরনে বক্তৃতা-বিবৃতি নানান জায়গা থেকে ফোন করে প্রচার করতে বারণ করে দেয়া হয়।

এক-এগারোর সামরিক সরকারের সময়ও যে এমনটাই ঘটবে, এটি আমি একরকম নিশ্চিত ছিলাম। তবুও একটু কৌশলের আশ্রয় নিলাম। ভাবলাম, কোথায়-কীভাবে এটি প্রচার করা যায়।

প্রেস ক্লাবেই দেখা হল সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা সুধীর কৈবর্ত্য দাসের সঙ্গে। চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক পদে কাজ করছেন তখন। তাকে বললাম, ঠিক সন্ধ্যা ৭টার খবরে চিঠির বিষয়বস্তু প্রচার করতে হবে। সে জানাল, তার বিকালে ডিউটি নেই। আমি বললাম, যেভাবেই হোক, এটি প্রচার করতে হবে।

সে আমার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘যা হওয়ার হবে। দেন আমাকে। আমি নিজে অফিসে গিয়ে এটি প্রচারের ব্যবস্থা করব।’ যে কথা, সেই কাজ। আমার কথায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেত্রীর চিঠি প্রচার করলেন সুধীর কৈবর্ত্য দাস চ্যানেল আইতে।

টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল শেখ হাসিনার দেয়া চিঠি। সঙ্গে তার বক্তব্য। মুহূর্তেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। প্রেস ক্লাবে বসেই আমি চিঠিটি ফটোকপি করে অন্যান্য গণমাধ্যমের সহকর্মীদের হাতে দেই। পরে তারাও অনেকে প্রচার করেছিলেন সেই চিঠি।

শেখ হাসিনার সেই চিঠির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লাইন ছিল এরকম, ‘প্রিয় দেশবাসী, আমার সালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায়, জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। তারপরেও মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে।

উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও দেশবাসী, আপনাদের ওপর আমার ভরসা। আমার প্রিয় দেশবাসী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন। কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। মাথানত করবেন না। সত্যের জয় হবেই।

আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। আমৃত্যু থাকবো। আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেনো, আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বোই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবোই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

এ একটি চিঠিই ওই সময় দেশের মানুষকে আবার ঐক্যবদ্ধ করেছিল। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে, এগিয়ে আসতে নতুন করে তাদের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। বেঁচে থাকার, স্বপ্ন দেখার জীবনবোধ দিয়েছিল।
সেদিন কাউকে জানতে বা বুঝতে দিলে এ চিঠি আর আলোর মুখ দেখত কিনা, সন্দেহ রয়েছে আমার। এক-এগারোর সামরিক সরকারের ফোনেই এটি গুম হয়ে যেত।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুধীর কৈবর্ত্য দাসের ওই দিনের ভূমিকাটি ছিল সত্যিই সাহসী এবং অসাধারণ। আজও আমি তার সেই ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।

আবুল কালাম আজাদ: প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস); সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন

Pin It