পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার প্রেস সচিব ইহসানুল করিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার এ কথা জানানো হয়।
সেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বিকালে সিনহার মাকে টেলিফোন করে সান্ত্বনা দেন এবং তার খোঁজ খবর নেন।
“তিনি নিহতের পরিবারকে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।”
ফোন করে খবর নেওয়ায় সিনহার পরিবার প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এক সময় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে দায়িত্ব পালন করা সিনহার বয়স ছিল ৩৬ বছর। তার বাবা প্রয়াত এরশাদ খান ছিলেন অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব।
৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় একটি চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা।
কক্সবাজারের পুলিশ বলছে, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি এ ঘটনায় আরও দুইজনকে গ্রেপ্তার করে দুটো মামলা দায়ের করার কথাও জানিয়েছে পুলিশ।
তবে ঘটনার যে বিবরণ পুলিশ দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরও তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে।
চেকপোস্টের ঘটনা নিয়ে পুলিশের দাবি প্রত্যাখ্যান করে সিনহার পরিবার বলেছে, তাকে ‘হত্যার উদ্দেশ্যেই’ পুলিশ গুলি করেছিল এবং এ অভিযোগে তারা মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মামলা করার ‘প্রস্তুতি নিচ্ছে’ সিনহার পরিবার
দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সিনহা ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরও তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে।
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন।
পরিবারের সবার সঙ্গে সিনহা রাশেদ খান: ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেপরিবারের সবার সঙ্গে সিনহা রাশেদ খান: ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়ে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
তবে ঘটনার যে বিবরণ পুলিশ দিয়েছে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। রাশেদ আদৌ অস্ত্র তাক করেছিলেন কি না, তা নিয়ে যেমন সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তেমনি পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিতে দুই ঘণ্টা দেরি হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। যিনি সেদিন গুলি ছুড়েছিলেন, সেই পরিদর্শক লিয়াকত আলিসহ বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ২০ পুলিশ সদস্যকে ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সিনহার বড় বোন শরমিন মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে ফোন করে আমার মায়ের সাথে কথা বলেছেন। খোঁজ নিয়েছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন, আশ্বস্থ করেছেন।”
চেকপোস্টের ঘটনা নিয়ে পুলিশের দাবি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, “বিচার পেতে হলে মামলা করতে হবে, সেজন্য আমরা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করছি। সকলের সাথে পরামর্শ নিয়ে ২/৩দিনের মধ্যে একটি হত্যা মামলা করা হবে।”
তাদের বাড়ি যশোরের বীর হেমায়েত সড়কে হলেও বাবা মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ খানের সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় তাদের থাকতে হয়েছে। সবশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব ছিলেন এরশাদ খান।
গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু: তদন্তের প্রথম দিন দীর্ঘ বৈঠক
গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু: ২০ পুলিশ প্রত্যাহার
৩৬ বছর বয়সী সিনহা ছিলেন অবিবাহিত। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় বোন শারমিন শাহরিয়া একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন, আর ছোট বোন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।
শারমিন বলেন, “আদনান আমার ৫ বছরের ছোট, ও ছিল আমাদের পরিবারের সবার এনার্জি সোর্স। যে কোনো বিষয় আমরা ওর পরামর্শই নিতাম। ২০০৭ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর ওই জায়গাটা আদনানই নিয়েছিল।”
৫১ বিএমএ লং কোর্সে অংশ নিয়ে সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া সিনহা ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাসে থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসরে যান।
“ও যখন চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল, তার দুই বছর পর অনুমতি মিলেছিল। তারা আদনানকে ছাড়তে চাচ্ছিল না। মায়ের কাছেও তারা অনুরোধ করেছিল, যেন ছেলেকে তিনি বোঝান।
বেড়াতে গিয়ে মা আর ভাগ্নিদের সঙ্গে সিনহা রাশেদ খান। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেবেড়াতে গিয়ে মা আর ভাগ্নিদের সঙ্গে সিনহা রাশেদ খান। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে“আদনান তাদের বলেছিল, সেনাবাহিনীতে ১৭/১৮ বছর চাকরি করে যেটুকু শেখার সে শিখেছে। এখন নতুন কিছু করার চিন্তা আছে তার।”
কী করতে চেয়েছিলেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান? শারমিন জানালেন, বিশ্বভ্রমণ ছিল তার ভাইয়ের ছোটবেলার স্বপ্ন।
ছোট ভাইয়ের ছেলেবেলার কথা স্মরণ করে আবেগ আপ্লুত শারমিন বলেন, “যখন ক্লাস টুতে পড়ে, তখন থেকে বলত সে হিমালয়ে যাবে। এজন্য টাকা দরকার। মায়ের পান খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে টাকা জমাতে বলত।”
পরে সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময় যখনই সুযোগ হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন সিনহা।
“ও ছিল হাসিখুশি, খুব প্রকৃতি ভালবাসত। পশুপ্রেমী ছিল। শুধু তাই নয়, সাপ দেখলেও সে হত্যা না করে এড়িয়ে চলার কথা বলত।”
পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু: তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন
টেকনাফের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত
সিনহার ইচ্ছা ছিল নিজের বিশ্ব ভ্রমণের সব খুঁটিনাটি তিনি প্রকাশ করবেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। এর মধ্যে রাজশাহী গিয়ে চার মাস ছিলেন সিনহা। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে তার এক বন্ধুর মায়ের গড়ে তোলা লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে নিজেকে বিশ্বভ্রমণের জন্য আরও তৈরি করা।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হয়ে যাওয়ায় তার পরিকল্পনা থমকে যায়। তখন ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর পরিকল্পনা করেন সাবেক এই সেনা সদস্য। কক্সবাজারের হিমছড়িতে সেই ডকুমেন্টারির কাজই তিনি করছিলেন বলে জানান শারমিন।
বাহারছড়ার শামলাপুর চেকপোস্টে সেই রাতের ঘটনায় অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটো মামলা করেছে পুলিশ। সে সময় গাড়িতে সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাত নামের এক যুবককে আসামি করা হয়েছে।
সিফাতের বরাত দিয়ে ওই ঘটনার ভিন্ন একটি বয়ান এসেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে, যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, পুলিশের নির্দেশে গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নেমে যান সিফাত। পরে সিনহাও নিজের পরিচয় দিয়ে হাত তুলে গাড়ি থেকে বের হন।
মা, দুই বোন আর ভাগ্নিদের সঙ্গে সিনহা রাশেদ খান। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেমা, দুই বোন আর ভাগ্নিদের সঙ্গে সিনহা রাশেদ খান। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেতখন ‘কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই’ সিনহাকে পুলিশ গুলি করে বলে সিফাতের ভাষ্যে তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল রোববার বলেন, বিষয়টি নিয়ে যেহেতু তদন্ত চলছে, সেহেতু তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই তদন্ত কমিটির সদস্যরা মঙ্গলবার সকাল থেকে কক্সবাজারের হিলডাউন সার্কিট হাউজে ছয় ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠক করেন।
মিজানুর রহমান পরে সাংবাদিকদের বলেন, বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করে তারা কর্ম-পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছেন।
“ঘটনাস্থলসহ মাঠপর্যায়ে যেখানে যাওয়ার দরকার সেখানে আমরা যাব। প্রত্যক্ষদর্শীসহ যাদের দরকার তাদের সঙ্গে কথা বলবে তদন্তদল। মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া সাত কর্মদিবসের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।”