দেশে পাইপলাইনের গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজির (তরলকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু এ ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে বাজার বিশৃঙ্খলাও জমাট বাঁধছে। বাড়ছে ক্রেতা-ব্যবহারকারীদের হয়রানিও। জ্বালানি পণ্যের মূল্য রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করেনি কোনো সরকার। যে ব্যবসায়ীরা এলপিজি আমদানি-উত্পাদন-বাজারজাত করছেন তারাই এর মূল্য নির্ধারণ-নিয়ন্ত্রণ করছেন। এর ফলে বিপুল সম্ভাবনার এ জ্বালানি পণ্যের দাম ও নিরাপত্তা নিয়ে বিশৃঙ্খলা-উদ্বেগ কাটছে না।
বিভিন্ন জেলার ভোক্তা এবং খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর দিকে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির পরিমাণ কমে গেলেও মে মাসের শেষ দিকে বিক্রি বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে এ পেট্রোলিয়াম পণ্যটির দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে সম্প্রতি এলপিজির দাম বেড়েছে। ১২ কেজির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম জেলাভেদে ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেড়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য এবং চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত এলাকায় পরিবহন খরচ বেশি দেখিয়ে খুচরা পর্যায়ে তা ১ হাজার ৫০ টাকা পর্যন্তও নেওয়া হচ্ছে।
উত্পাদন, পরিবহন, ভর্তুকি ও আমদানি-রপ্তানির খরচের পার্থক্যের কারণে দেশভেদে এলপিজির দামও ভিন্ন হয়ে থাকে। কলকাতায় প্রতি ১৪ দশমিক ২ কেজির ভর্তুকিহীন সিলিন্ডারের দাম ৭০৪ টাকা (৬২১ রুপি) আর ভর্তুকিযুক্ত সিলিন্ডারের দাম আরো কম। এ হিসাবে ভারতে প্রতি কেজি এলপিজির দাম ৫০ টাকারও কম। অন্যদিকে বাংলাদেশে ১২ কেজির সিলিন্ডারের গড় দাম ৯০০ টাকা করে ধরলেও প্রতি কেজি এলপিজির দাম ৭৫ টাকা দাঁড়ায়। এলপিজির মূল্য নির্ধারণ বা সমন্বয়ে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এলপিজি আমদানিকারক এবং বোতলজাতকারী বা বাজারজাতকারীরা এ মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন। ডিলার এবং খুচরা বিক্রি পর্যায়ে শৃঙ্খলা না থাকায় কোম্পানিগুলোর অগোচরেও দাম বাড়ে। এর চূড়ান্ত আঘাত পড়ে খুচরা ভোক্তা পর্যায়ে। অথচ আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এ মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং নির্ধারণ করার কথা।
জ্বালানি বিভাগ, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং খাত সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, এলপি গ্যাস বেশি ব্যবহূত হয় বাসাবাড়ির রান্নাঘরে এবং ছোটবড় রেস্টুরেন্টে। দেশে বর্তমানে গ্রাহকদের চাহিদা বার্ষিক ১৫ লাখ টন। তবে আমদানি ও বিক্রি হচ্ছে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। এর মধ্যে ২০ হাজার টনেরও কম এলপিজি সরকারিভাবে বিক্রি হয়। এগুলোর সিংহভাগ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবহূত হয়। দুইটি সরকারি এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও তা এখন পর্যন্ত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। প্রকৃত অগ্রগতি নেই।
এদিকে দেশে এলপিজি ব্যবসার জন্য প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে ৫৭টি কোম্পানি। এর মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন বা বাজারজাত করার অনুমোদন পেয়েছে সাতটি কোম্পানি। এই সাতটিসহ চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা ২২টি কোম্পানি খুচরা বাজারে এলপি গ্যাস বিক্রি করছে। বিক্রি বিবেচনায় এগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বসুন্ধরা এলপিজি। তবে এলপিজি আমদানি ও বোতলজাতকারী কোম্পানিগুলোর একাধিক কর্মকর্তারা নিজেরাও স্বীকার করেছেন বাজারে শৃঙ্খলা না থাকার কথা।
অন্যদিকে গ্রাহকরা বলছেন, বোতলের গায়ে মূল্য লেখা না থাকায় বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম দাবি করে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে হঠাত্ করে দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার অনেক সিলিন্ডারে যে পরিমাণ এলপিজি থাকার কথা বোতলে তার চেয়েও কম পরিমাণে থাকে। এর মাধ্যমে জনগণ ঠকছেন। আবার অনেক সিলিন্ডার ঠিকমতো সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিসুর রহমান বলেন, বিইআরসি আইনে সব ধরনের জ্বালানির দাম নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটি হয়নি। এখন সরকার বিইআরসিকে এ মূল্য নির্ধারণ নীতিমালা তৈরি করতে বলেছে। সেটি পাওয়ার পর বাস্তবায়ন করবে। দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকা ওমেরা এলপিজির হেড অব করপোরেট প্ল্যানিং তানজিম চৌধুরী বলেন, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজার ও বাস্তবতা বিবেচনায় মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। এ জন্য বিইআরসি সব অংশীদারদের মতামত নিতে পারে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, এলপিজির মূল্য নির্ণয় এবং নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিইআরসির সদস্যের (গ্যাস) নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ শুরু করেছে। আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ কমিশন মতামত দেবে।