২১ অগাস্ট নিয়ে যা বললেন গয়েশ্বর-রিজভী

rijvi-21-augut-210820-04

একুশে অগাস্ট হামলায় তারেক রহমানসহ বিএনপি সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সাজা হলেও দলটির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আওয়ামী লীগের সমাবেশে ওই হামলার উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি নেতৃত্বের জন্য ‘কবর রচনা’।

ভয়াবহ ওই সন্ত্রাসী হামলাই এক-এগারো অর্থাৎ সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পথ তৈরি করেছিল বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।

আর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, ওই হামলা ছিল মহাপরিকল্পনার অংশ, ‘যা জানতেন’ শেখ হাসিনা।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত এবং কয়েকশ মানুষ আহত হন। হামলা চলাকালে মানববর্ম তৈরি করে তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন দলের নেতাকর্মীরা। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের শব্দে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই হামলায় সংশ্লিষ্টতার দায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ওই সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরীসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন।

ইতিহাসের জঘন্যতম এই হামলার ১৬ বছর পূর্তিতে শুক্রবার এক আলোচনা সভায় বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও রুহুল কবির রিজভী এ বিষয়ে কথা বলেন।

গয়েশ্বর বলেন, “২১ অগাস্টের ঘটনাটা হাসিনাকে মারার বড় চক্রান্ত- এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। যদি থাকে এই চক্রান্ত ছিল সেদিন জাতীয়তাবাদী শক্তির নেতৃত্বের কবর দেওয়া। এটা একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বিএনপির ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে।

“ওই ঘটনার প্রকৃত দোষীরা এখনও বেঁচে আছে, নিরাপদে বেঁছে আছে এবং ভালো আছে। তারা দেশে আছে, দেশের বাইরেও আছে। সেটা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কারও অজানা থাকার কোনো কারণ নাই। সেটা দেশি-বিদেশি গোয়েন্দারা যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করে তাহলে এটা তাদের নখদর্পনে থাকার কথা। যেহেতু এটা একটি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ব্যাপার সেই কারণে আসল ঘটনা কখনও আলোর মুখ দেখবে না, আপনারা-আমরা জানব না।”
গয়েশ্বর বলেন, “এই যে রং অ্যাপ্লিকেশন পলিটিক্সে- মিথ্যা দিয়ে সত্যকে চাপা দেওয়া, দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক রাজনীতিকে দুর্ঘটনায় ফেলা। ২১ অগাস্ট এই রকম ঘটনা এক-এগারোর কোনো রি-অ্যারেজমেন্ট হতে পারে।

“এক-এগারোয় কে ভিকটিম হয়েছে? বিএনপি হইছে, খালেদা জিয়া হইছে। এক-এগারোয় লাভবান হয়েছে কে? হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ। তাহলে ডাউট অব দ্য বেনিফিসিয়ারি যদি বলা হয়, এক-এগারোর মাধ্যমে বেনিফিট হয়েছে বিএনপির অতি মুখোমুখি প্রতিপক্ষের।”

ওই হামলায় বিএনপির সংশ্লিষ্টতা কেন থাকতে পারে না সেই ধারণার পক্ষে যুক্তি দিয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, “দুইশর উপরে আসন নিয়ে তখন বিএনপি ক্ষমতাসীন। একটা স্ট্যাবল ক্ষমতাসীন সরকার কখনোই চাইবে না সেই সরকারকে আনস্ট্যাবল করতে। ২১ অগাস্টের ঘটনাটা রাষ্ট্রকে আনস্ট্যাবল করা, উসকানি দেওয়া, সুঁড়সুঁড়ি দেওয়া অর্থাৎ সরকারকে বিব্রত করে দেশে-বিদেশে সকল ক্ষেত্রে।

গয়েশ্বরের পুত্রবধূ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরীও বক্তব্য দেন।গয়েশ্বরের পুত্রবধূ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরীও বক্তব্য দেন।“এটা যদি প্রতিষ্ঠিত হত, এটা যদি জনগণ বিশ্বাস করতে পারত যে, এটা সরকার করেছে অথবা খালেদা জিয়া করেছে বা তারেক রহমান করেছে, তাহলে সেদিন সরকার থাকার কথা না। তখন একটা পাতা নড়ে নাই, একটা আওয়াজ হয় নাই। এটা জনগণের বোঝা হয়ে গেছে যে, এই অপকর্ম সরকার করতে পারে না, একটা গণতান্ত্রিক সরকার করতে পারে না, এটা একটা দায়িত্বশীল সরকার কোনো মতেই করতে পারে না- এটাই আমি ভারতীয় টেলিভিশনে সেদিন বলছিলাম।”
ক্ষমতায় থাকাকালে নিজেদের সরকারের ভুল-ভ্রান্তির কথা স্বীকার করে গয়েশ্বর বলেন, “মনের ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সরকারে থাকতে ভুল-ভ্রান্তি আমাদের কিছু ছিল। যার খেসারত আজকে জনগণ দিচ্ছে, আজকে আমরা দিচ্ছি, খেসারত তারেক রহমান দিচ্ছে, খেসারত খালেদা জিয়া দিচ্ছে।

“তবে যারা অপকর্ম করেছে তারা খেসারত দেয় নাই, তারা কিন্তু আমাদের আশপাশে আরও বলীয়ান হওয়ার চেষ্টা করছে। এটা (২১ অগাস্টের হামলা) বাংলাদেশের ভাবনা থেকে হয় নাই, এই ভাবনার পরিকল্পনা অন্য কোথাও বাস করে।”

তিনি বলেন, “তবে এটাও ঠিক, এই গ্রেনেড হামলায় যারা সম্পৃক্ত তারা ভিকটিম হয় নাই, আসামি হয় নাই। এখানে আমাদেরও ব্যর্থতা আছে। আর সরকার সেই পারপাসটা ভালো করে আমাদের উপরে চাপিয়ে দিতে পারছে। অর্থাৎ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে যদি চিন্তা করত, চেষ্টা করত- উনি খুব ভালো করে জানেন, যেই ঘটনাটা কেন ঘটছিল এবং কারা ঘটাইছিল। এতদিনে উনার অজানা থাকার কথা নয়।”

‘এটা আওয়ামী লীগের মাস্টার প্ল্যান’

একুশ অগাস্টের হামলা নিয়ে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেন, “ওই ঘটনার সাথে বিএনপিকে জড়ানো, তারেক রহমানকে জড়ানো- তখনই বুঝা যায় এটা একটা মাস্টারপ্ল্যান। এই মাস্টার প্ল্যান শেখ হাসিনা জানতেন।
“ওই ঘটনার সাথে যদি তারেক রহমান জড়িত হয় তাহলে আপনাদের আন্দোলনের ফসল মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা চার্জশিটে দেয়নি কেন? আপনাকে এসে দিতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতা কবজা করে, আইন-আদালত কবজা করে তার নাম যুক্ত করতে হয়েছে। তাতে কি প্রমাণিত হয় না যে, এই মামলায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নাম প্রতিহিংসায় দেওয়া হয়েছে, আক্রোশবশত দেওয়া হয়েছে?”

রিজভী বলেন, “আপনাদের লোকরা যখন দিতে পারেনি, আপনি এসে দিলেন। আপনি মনের মধ্যে ছটফট করছিলেন, কখন ক্ষমতায় আসব, তারেক রহমানকে ধরব। আমি প্রফেশনাল অ্যাডভোকেট নই, তারপরও যতটুকু স্টাডি করে দেখেছি কোথাও বিন্দুমাত্র ন্যূনতমভাবে তাকে জড়ানোর কোনো স্কোপ সেখানে নেই। আপনাকে এসে দিতে হলো রাষ্ট্রক্ষমতা কবজা করে আইন-আদালত কবজা করে তার নাম যুক্ত করতে হয়েছে। তাতে কি প্রমাণিত হয় না যে, এই মামলায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নাম প্রতিহিংসায় দেওয়া হয়েছে, আক্রোশবশত দেওয়া হয়েছে।

“আপনি তারেক রহমানকে জড়িত করেছেন রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে সাক্ষীকে জোর করে, টর্চার করে, পিটিয়ে নিপীড়ন করে। আপনি সাক্ষীদের মুখ দিয়ে এই সব কথা বলিয়েছেন। সেই মুফতি হান্নান আবারও ১৬৪ করে সেখানে তার ওপর টর্চার যেটা করা হয়েছে তার বর্ণনাও আছে। কীভাবে আঙুলের নখ তোলা হয়েছে, পায়ের নখ তোলা হয়েছে এভাবে টর্চার করে তার স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল। এটাও কিন্তু আদালতে আমলে নেওয়া হয়নি।”

রুহুল কবির রিজভী বলেন, “এই ঘটনার আসল রহস্য এটা অনাবিষ্কৃত রয়ে গেল। এটা যদি সত্যিকার অর্থে একটা গণতান্ত্রিক সরকার আসে, একটা সুষ্ঠু তদন্তের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা যায় তখনই বোঝা যাবে যে, এখানে কে দায়ী। শেখ হাসিনার মাস্টার প্ল্যানে একটা ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলো সেটা খুব সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।”

এই স্লোগানে গয়েশ্বরের ‘মন ভরে না’

দলের নেতাকর্মীদের বুদ্ধিদীপ্ত স্লোগান দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “‘এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে/আরো জোরে’ এসব আপনাদের স্লোগানের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শগত কী তথ্য জনগণের কাছে আপনারা দেন? আপনাদের স্লোগানে তো জনগণের ভাষা নাই। কেন নাই? যেদিন কোরাজান একুইনো পাস করলেন ফিলিপাইনের নির্বাচনে সেদিন ম্যাডাম বগুড়াতে। রাত্রি ১টায় ফলাফল প্রকাশ হল।

“পরদিন আমরা বগুড়া থেকে জয়পুরহাটে যাই। পেছনে আমরা দুটি গাড়ির মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। আমি যুব দলের সেক্রেটারি হিসেবে আরও অনেকের সাথে আমরা আওয়াজ তুললাম, ‘বাংলাদেশের কোরাজান, খালেদা জিয়া লও সালাম’। তার মানে, এটা একটা মেসেজ জনগণের কাছে। আমরা কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে জনগণের ভাষাগুলো ফুটিয়ে তুলেছি। আজকে কি আছে সেটা? আমাদের মধ্যে সেটা নাই।”

নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় ঢাকা জেলা বিএনপির উদ্যোগে সদ্য প্রয়াত সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানের স্মরণে এই আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল হয়। আলোচনা সভা শেষে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন উলামা দলের আহ্বায়ক শাহ নেসারুল হক।

গত ৪ অগাস্ট রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদ আবদুল মান্নান।

জেলা সভাপতি দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবু আশফাকের পরিচালনায় আলোচনা সভায় দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, ধামরাই ‍উপজেলা চেয়ারম্যান তমিজউদ্দিন আহমেদ ও প্রয়াত নেতার একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার মেহনাজ মান্নান বক্তব্য রাখেন।

Pin It