গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই চলেছে সরকার। নতুন অর্থবছরের দেড় মাসেই সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়ে গেছে সরকারের।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের ব্যাংক ঋণের সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের দেড় মাসে (১ জুলাই থেকে ১২ অগাস্ট) সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১০ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার।
তবে এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি সরকার। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের দুই হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। সে হিসাবে ১২ অগাস্ট পর্যন্ত সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৪২২ কোটি টাকা।
রাজস্ব আদায়ে করুণ দশার কারণে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবেলাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংকের দারস্থ হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গিয়ে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার রক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে রাজস্ব আদায়ে ধস নামায় সংশোধিত বাজেটে সেই লক্ষ্য বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা ধরা হয়।
মহামারী মোকাবেলায় গত অর্থবছরের শেষ চার মাসে (মার্চ থেকে জুন) দাতাদের কাছ থেকে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারের নিট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১ হাজার ৯০৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায় কম হলে দেশ চালাতে সরকারকে তো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেই হবে। সেই কাজটিই করছে সরকার। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
“আমাদের কপাল ভালো যে, এই মহামারীর সময়ে মোটা অংকের বিদেশি ঋণ পাওয়া গেছে। তা না হলে বড় ধরনের সংকট দেখা দিত।”
তিনি বলেন, “বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত অর্থবছরের শেষ তিন মাস দেশের অর্থনীতি একপ্রকার অচল হয়েই ছিল। তাতে যতটা সঙ্কটে পড়ার কথা ভাবা হচ্ছিল, বিদেশ থেকে ‘ভালো’ ঋণ সহায়তা পাওয়ায় ততটা সঙ্কটে সরকারকে পড়তে হয়নি।
“যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে অর্থের জন্য সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছিল। এক সময় মনে হচ্ছিল, সরকারের ব্যাংক ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু বিদেশি ঋণের কারণেই অর্থবছরের শেষ দিকে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমে এসেছে। শেষ পর্যন্ত ৬১ হাজার কোটি টাকার মত নিতে হয়েছে।”
ব্র্যাক ক্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “সরকার তো এবার ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্যই ধরেছে। এখন দেখতে হবে, অর্থবছর শেষে সেটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।”
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরুর দিকেও সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল। ওই অর্থবছরের জুলাই মাসের প্রথম ২৮ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া হয়েছিল ১৬ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। সে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ শোধ দেয়া হয়েছিল দুই হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা।
মহামারীর মধ্যে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১২ হাজার ৩৩৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৩৭৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে লক্ষ্যের চেয়ে সাত হাজার ৪৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৩৫ ভাগ কম হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে কম আদায় হয়েছে ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
অথচ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাসে ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছিল।