ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে দিনভর উত্তেজনা এবং শোরগোল শেষে সোনিয়া গান্ধীই ভারতের কংগ্রেস পার্টির অন্তর্বর্তী সভাপতি থাকছেন। দলীয় নেতাদের অনুরোধে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।
দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে অসন্তোষের জেরে সোমবার বেলা ১১টার দিকে কংগ্রেস পার্টির ওয়ার্কিং কমিটি অনলাইনে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বসে। শুরু থেকেই নানা পক্ষের বক্তব্য নিয়ে বৈঠকে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের শতাব্দী প্রাচীন দল কংগ্রেস পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্ব এখন আর গোপন নেই। সম্প্রতি দলের ২৩ জ্যেষ্ঠ নেতা ‘দলীয় নেতৃত্বে’ পরিবর্তন চেয়ে চিঠি লেখার পর দলের শীর্ষ পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে ‘পূর্ণ সময়ের সভাপতি’ মনোনয়নের সুপারিশ করেছিলেন সোনিয়া গান্ধী।
এ পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের হাল কার হাতে যাচ্ছে? গান্ধী নাকি এ পরিবারের বাইরের কেউ- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সোনিয়া আপাতত আবারও দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ায় সে প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গেল। তবে ওয়ার্কিং কমিটি নতুন সভাপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা।
সকাল থেকে কী ঘটেছে?
সোনিয়াকে গত ৭ অগাস্ট ২৩ নেতার পাঠানো চিঠিটি রোববার ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরই কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি সোমবার ভার্চুয়াল বৈঠক ডেকেছিল। সে বৈঠকেই অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর পদ ছেড়ে দিতে চান সোনিয়া গান্ধী।
৭৩ বছরের সোনিয়া শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় প্রশ্ন উঠেছে, তিনি আর কত দিন দল চালাতে পারবেন? সোনিয়া পদ থেকে অব্যাহতি চাওয়ায় তার উত্তরসূরি মনোনয়নই ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও বৈঠকের শুরুতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, সোনিয়ার নেতৃত্বের প্রতি দলের পূর্ণ আস্থা আছে।
গতবছর জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর নেতাদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধী সরে দাঁড়ানোর পর নেতৃত্ব নিয়েছিলেন সোনিয়া। রাহুল দায়িত্ব ছাড়ার সময় ওয়ার্কিং কমিটিকে গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে নেতা খুঁজে নেওয়া কথাও বলেছিলেন। তখন দলীয় নেতাদের অনুরোধেই অন্তর্বর্তী সভাপতি হতে রাজি হন সোনিয়া।
বৈঠকে শোরগোল
সোমবারের বৈঠকে সোনিয়া বা রাহুল কাউকেই আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক দেখা যায়নি। ওদিকে, এক খবরে রাহুলের একটি মন্তব্য নিয়ে বৈঠকে তুমুল শোরগোল হয়েছে।
সোনিয়াকে চিঠি লিখে কার্যত দল পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ‘২৩ নেতার অনেকের সঙ্গেই ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সম্পর্ক রয়েছে’ অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাহুল- স্থানীয় গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর প্রকাশের পর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন জ্যেষ্ঠ নেতারা। সোমবার জরুরি ভিত্তিতে ডাকা কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে রীতিমত শোরগোল বেঁধে যায়।
আনন্দবাজার জানায়, যে ২৩ নেতা সোনিয়াকে চিঠি লিখেছিলেন তাদের মধ্যে গোলাম নবী আজাদ, কপিল সিব্বল, আনন্দ শর্মার মতো রাজ্যসভার সদস্য, শশী থারুর, মণীশ তিওয়ারির মতো লোকসভার সদস্য, বীরাপ্পা মইলি, রেণুকা চৌধুরীর মতো সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, জিতেন প্রসাদ, মিলিন্দ দেওরা, সন্দীপ দীক্ষিতের মতো তরুণ নেতা, ভূপিন্দ্র সিংহ হুড়া, পৃথ্বীরাজ চহ্বাণদের, রাজেন্দর কউর ভট্টলদের মতো সাবেক মুখ্যমন্ত্রীরা রয়েছেন।
তাদের দাবি, দলে ‘স্থায়ী এবং কার্যকর নেতৃত্ব’ দরকার। যারা দলের নেতৃত্বে থাকবেন তাদের সবসময় জনগণের সামনে এবং সক্রিয় ভূমিকায় থাকতে হবে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দল চালাবেন।
এই নেতাদের বিরুদ্ধে রাহুলের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় সবচেয়ে সরব প্রতিবাদ জানান গোলাম নবী আজাদ ও কপিল সিব্বল। আজাদ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ দিতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন’।
আর সিব্বল বৈঠক চলার সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে টুইট করে বসেন। লেখেন, ‘‘রাহুল গান্ধী বিজেপি’র সঙ্গে আমাদের যোগসাজশ থাকার কথা বলছেন। রাজস্থান হাই কোর্টে কংগ্রেসকে রক্ষায় সাফল্য পেয়েছি। মণিপুরে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দলের লড়াইয়ে সঙ্গ দিয়েছি। গত ৩০ বছর বিজেপির সমর্থনে একটা কথাও বলিনি। তবুও বিজেপি’র সঙ্গে আমাদের আঁতাঁত!’’
পরে অবশ্য আর ওই টুইট খুঁজে পাওয়া যায়নি। সিব্বল দ্রুত সেটি সরিয়ে নিয়ে নতুন পোস্টে লেখেন, ‘‘রাহুল গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জানিয়েছেন, আমাকে দায়ী করে তিনি কখনওই কিছু বলেননি। তাই আমি আমার টুইট প্রত্যাহার করে নিয়েছি।”
কংগ্রেস থেকেও এক টুইটে রাহুল গান্ধী ‘এ ধরনের একটি শব্দও বলেননি, এমনকি ইঙ্গিত পর্যন্ত করেননি’ বলে জানানো হয়েছে। ‘‘সংবাদমাধ্যমগুলো এটা নিয়ে ‘মিথ্যা বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।’’
কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র কী বলছে?
ভারতের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর গতবছর ২৫ মে সভাপতির পদ ছাড়েন রাহুল গান্ধী। তারপর নেতাদের অনুরোধে অনেকটা বাধ্য হয়েই গত বছর ১০ অগাস্ট সোনিয়া দলের অন্তর্বর্তী সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সভাপতির মেয়াদ সর্বোচ্চ এক বছর। এরই মধ্যে সোনিয়ার সেই মেয়াদ পার হয়ে গেছে। এছাড়া, যদি সভাপতির মৃত্যু হয় বা তিনি পদত্যাগ করেন তবে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির (এআইসিসি) সবচেয়ে প্রবীণ সাধারণ সম্পাদক অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব নিয়ে একজন সভাপতি নির্বাচন করবেন।