ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত কথা হল, আরব বণিকদের মাধ্যমেই এদেশে ইসলাম এসেছে। তবে ইসলাম প্রচারকদের আগমনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে বেশ কথা থাকলেও বিশুদ্ধ মত হল মহানবী (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায়ই এদেশে ইসলামের দাওয়াত এসে পৌঁছায়।
নবুওয়াতের সপ্তমবর্ষে (৬১৭ খৃস্টাব্দে) সাহাবী হজরত আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের (রা.) চীনে আগমনই এ কথার পক্ষে জোরালো প্রমাণ বহন করে।
সাহাবী হজরত কাসেম ইবনে হুজাইফা (রা.), উরওয়া ইবনে আসাসা (রা.), আবু কায়েস ইবনুল হারিসও (রা.) এ সফরে তার সঙ্গী ছিলেন।
চীনে যাবার পথে তারা বাংলাদেশের বন্দর বিশেষত চট্টগ্রাম ও সিলেট নোঙ্গর করেছেন এবং তাদের সান্নিধ্যে এসে এদেশের কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এখান থেকেই বাংলাদেশ ইসলামের যাত্রা।
প্রাক ইসলামি যুগেই আরব বণিকরা সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া ও চীন পর্যন্ত তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেন। আরব-চীনের মধ্যে তাদের কয়েকটিঘাঁটিও ছিলো।
এ পথে তাদের প্রথম ঘাঁটি ছিলো মালাবর। তারা নিয়মিত মালাবরের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীনে আসা যাওয়া করতেন। এভাবেই চট্টগ্রাম ও সিলেট তাদের যাতায়াতের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হত।
মূলত এ সূত্র ধরেই নাম নাজানা আরো বহু সাহাবী দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তির্ণ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে ইসলাম প্রচারে কাজ করেছেন। চীনের ক্যন্টনসমুদ্র তীরবর্তী হজরত আবু ওয়াক্কাসের (রা.) মাজার আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে আছে।
সমুদ্র তীরের কোয়াংটা মসজিদও তিনিই নির্মাণ করেন বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
তবে ঐতিহাসিকদের সব মতামত ও গবেষকদের গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের চাঞ্চল্যকর যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সব রকমের সন্দেহ ও সংশয়ের অবসানতো ঘটেছেই উন্মোচিত হয়েছে ইতিহাসের নতুন দিগন্ত।
লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের বড়বাড়িতে রামদাস মৌজার,মসতারপাড় নামক স্থানে ৬৯ হিজরিতে (আনুমানিক ৬৯২ খ্রি.) নির্মিত একটি মসজিদ পাওয়া গেছে।
এই মসতারপাড় স্থানটি বহুকাল ধরে কয়েকটি উঁচু মাটির টিলা ও জঙ্গল দ্বারা আবৃত ছিল। যার স্থানীয় নাম ‘মজদের আড়া’।
১৯৮৭ সালে জমির মালিক তা আবাদযোগ্য করার চিন্তা করে জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রাচীনকালের তৈরি ইট, যাতে আঁকা ছিল ফুল। আরমাটি ও ইট সরাতে সরাতে আশ্চর্যজনকভাবে পূর্ণ একটি মসজিদের ভিত খুঁজে পাওয়া যায়।
এর মধ্যে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়, যার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে আরবিতে লেখা আছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি ৬৯ সাল।’
খননের পর মসজিদের মেহরাব এবং মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও খুতবার মিম্বরও আবিষ্কৃত হয়। এলাকার লোকজন এ মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানোমসজিদ’।
তাই নিশ্চিত বলা যায় আরব থেকে আগত মুসলমান বা স্থানীয় মুসলমান- যারা ৬৯ হিজরিতে এ এলাকায় বসবাস করেছিলেন তারাই নিজেদের ধর্মীয় প্রয়োজনে মসজিদও তৈরি করেছিলেন। সেই থেকে বা তার আরো আগে থেকেই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের কাজ আরম্ভ হয়।
‘জাতীয় অধ্যাপক’ দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের মতে, হজরত ওমরের (রা.) শাসনামলে মামুন, মুহাইমেন (রা.) নামক সাহাবিদ্বয় বাংলাদেশে আগমন করেন।
ইসলাম প্রচারের এ ধারা আব্বাসী খেলাফতকালে আরও জোরদারহয়। রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধবিহার খননকালে দুটি আরবীমুদ্রা পাওয়াযায়। এই মুদ্রা দুটি তৈরী হয়েছিল ৭৮৮ খৃস্টাব্দে অর্থাৎ আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদের আমলে।
ইতিহাসবিদ ড.এনামুল হকের মতে, কোন ইসলাম প্রচারক এই মুদ্রাগুলো বহন করেছিলেন। পাহাড়পুরে আসার পর বৌদ্ধদের হাতে তিনি শহীদ হন।
কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে খননকালে আব্বাসী যুগের আরও দু’টি স্বর্ণমুদ্র পাওয়া যায়।
এসব মুদ্রা এ কথাই প্রমাণ করে, খৃস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে এদেশে আরব মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের চর্চা ও প্রচারের কাজ চালুছিল।
তোফায়েল গাজালি
লেখক: পরিচালক, আল কোরআন ইনস্টিটিউট, ঢাকা