ঢাকা থেকে মাত্র ৭১ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর বেলাব উপজেলা; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে সেখানেও অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন সরকারি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা। তবে তাতে সাড়া মিলছে না।
বেলাবর দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইসলাম উদ্দিন জানান, ফেইসবুক লাইভে ক্লাস নেওয়া হলেও শতকরা ৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত হচ্ছে না।
বিভিন্ন জেলায় খবর নিয়ে এমন কথাই শোনা গেল।
বাগেরহাটের খারদ্বার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাকিবুল হাসানের কাছে হ্যালোর সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল- কেন সে অনলাইন ক্লাসে যায় না?
উত্তরে সাকিব বলে, “আমাদের তো বড় ফোন (স্মার্ট ফোন) নাই, তাই আমি করতে পারছি না।”
সাকিবের বাবা মো. শাহিনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের জন্য ঠিকমতো বাড়ি ভাড়াই দিতে পারি না, ফোন কিনব কীভাবে?”
সাকিবুলের মা সালমা বেগম বলেন, “বাসায় বসে ছেলে ক্লাস করার সুযোগ পাইতেছে না। পড়াশোনায় পিছায় যাইতেছে।”
বেলাবর দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইসলাম বলেন, “কতজনের স্মার্টফোন আছে? ৫ বা ১০ ভাগ অভিভাবকের হয়ত স্মার্টফোন আছে, কিন্তু কতজন অভিভাবক শিক্ষার্থীকে মোবাইল দিচ্ছে? কতজনের বাড়িতে ওয়াইফাই আছে? দিনে ৪টা ক্লাস হয়, ২৫ মিনিট করে ১০০ মিনিট। সেজন্য নেট কিনতে তো টাকা লাগে। এ টাকা তাদের কাছে নাই।”
নেটওয়ার্ক সমস্যা, বিদ্যুৎ বিভ্রাটও অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতির হার কমিয়ে দিচ্ছে বলে জানান শিক্ষকরা।
“আমরা খুব বেশি শিক্ষার্থীর সাড়া পাচ্ছি না। একটা ক্লাস নিলে দেখা যায় তিন-চারজন ক্লাসটা করতে আসছে,” বলেন ইসলাম।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঢাকার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস শুরুর পর সরকারও সেই পথে এগোয়। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংসদ টিভিতে ক্লাস চালু রাখার পাশাপাশি শুরু হয় অনলাইন ক্লাস।
সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থাকা শহরবাসী শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের সুবিধা নিতে পারলেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা তা পারছে না, যা দেশের প্রকট অর্থনৈতিক বৈষম্য মেলে ধরেছে।
তাদের এই পিছিয়ে পড়া গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বাড়িয়ে দেবে বলে সতর্ক করেছেন শিক্ষাবিদরা।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার শালমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাইজিদ বলে, অনলাইন ক্লাস তাদের ধারণার বাইরে।
“গ্রামে একশটা বাড়ির মধ্যে একটা বাড়িতে টিভি আছে। সেজন্য সংসদ টিভিতে ক্লাস দেখতে পারি না। ইন্টারনেটও খুব দুর্বল। স্কুল খুলে দিলেই আমাদের ভালো হয়।”
রাঙামাটি সরকারি কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রিমেল চাকমা ক্লাস নেন জেলার লংগদু উপজেলার সীমান্ত প্রহরী আদর্শ বিদ্যালয়ে।
তিনি বলেন, “এখানের স্কুলগুলোতে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। আমাদের স্কুলেও আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু করব। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মোবাইল না থাকার কারণে এবং নেটওয়ার্কের সমস্যায় ক্লাস দেখতে পারছে না।
“আমাদের কলেজেও ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু আমরা দেখতে পারছি না। কারণ এখানে তো নেটওয়ার্কই পাওয়া যায় না।”
বরিশালের সরকারি বিএম কলেজের শিক্ষার্থী দুর্গা প্রসাদ সরকার সুদীপ জানান, প্রতিদিন ফেইসবুক লাইভে ক্লাস হলেও ৩০ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত হন না।
তিনি বলেন, “তিন ভাগের একভাগ শিক্ষার্থীর ডিভাইস নেই, অনেকের নেটওয়ার্ক সমস্যা- এসব কারণে অনেকে ক্লাসে আসতে পারছে না।”
উপযুক্ত ডিভাইস না থাকায় ক্লাস নিতে পারছেন না শেরপুরের নকলা উপজেলার বানেশ্বর্দী খন্দকার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক রাশিদা বেগম বলেন, “আমাদের অনলাইন ক্লাস নেওয়ার জন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডিভাইস না থাকায় আমরা ক্লাস নিতে পারছি না।”
স্কুলগুলো অনলাইনে ক্লাস না নিলেও জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ফেইসবুক লাইভে ক্লাস হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার মঙ্গলকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দ্বীপ নারায়ণ দাস।
“ক্লাস শুরুর আগে আমরা সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসের বিষয়ে জানিয়েছি। তারপরও ডিভাইস না থাকায় তারা ক্লাস করতে পারছে না।”
রাজশাহীর মোহনপুর সরকারি কলেজে অনলাইন ক্লাস হলেও আশানুরূপ উপস্থিতি নেই।
তবে কলেজের অধ্যক্ষ মফিজ উদ্দিন কবিরাজ মনে করেন, নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের খরচের চেয়েও মানসিকতার সমস্যাই এর বড় কারণ।
“এখন তো নেটওয়ার্ক ও এমবি কেনার সমস্যা দেশে তেমন নাই। কিছু অভাব তো অবশ্যই আছে। সবার অবস্থা তো সমান না। এমনকি মৌলিক অভাবও দু-চারজনের থাকে। কিন্তু অনভ্যস্ততা, অলসতা, সরাসরি ক্লাস করে অভ্যস্ততা- এসব কারণেই অনেকে আসছে না ক্লাসে।”
তবে বেলাবর শিক্ষক ইসলাম বলেন, “শহরে তো সবাই নেটওয়ার্কের আওতায় আছে, গ্রামে সে সুযোগ নাই। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে।
“আমার অনেক ছাত্রকেই দেখেছি, তারা সিএনজি চালায়, অটো চালায়, রিকশা চালায়। সিক্স-সেভেনে পড়ে এমন অনেক শিক্ষার্থীরও এ মহামারীর সময়ে বিয়ে হয়ে গেছে।”
ফেনীতে রেল স্টেশনে হ্যালোর সাংবাদিকের নজরে পড়া ১২ বছরের আকরাম হোসেন বলে, “করোনার জন্য স্কুল বন্ধ, তাই এখন বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করছি। এখন আমরা চলতে পারতেছি না, তাই এই কাজ করা লাগতেছে।”
সমস্যা প্রকট হচ্ছে
মহামারীতে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠা সম্ভবপর হবে না বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান।
তিনি বলেন, “আমরা ছুটি বাড়াচ্ছি, সমস্যা সমাধানে কেউ সামষ্টিক পরিকল্পনা করছে- সেটা দৃশ্যমান না।
“অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে যাবে, কৃষির ক্ষতিও পোষাবে; কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল, সেটা সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে আগামী ২০ বছরে সম্ভব হবে কি না, সন্দেহ আছে।”
কারণ ব্যাখ্যা করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, “ক্ষতিটা কাটানো সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে এর কারণে ঝরে পড়ার সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে, কারণ মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। যেসব ছেলেরা এ সময়ে চাকরি করছে বা বাপের সাথে গ্রামে ছোটখাট ব্যবসা করছে- ওদের বিরাট অংশের ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই। অনেকে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।”
সিলেবাসে কমিয়ে আনা কিংবা পরের শিক্ষাবর্ষ সমন্বিত করার পক্ষপাতি নন এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “এতে খুব চাপ পড়বে। লেখাপড়ার কোনো শর্টকাট নেই। ছুটি বাড়িয়ে বাড়িয়ে এটা সমাধান নয়, সমাধানের জন্য একটা সমষ্টিগত পরিকল্পনা দরকার। সেটা নিচ্ছে কি না, তা আমরা জানি না।”
সংসদ টিভিসহ অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থাপনায় ক্লাস নেওয়া হলেও অনেক শিক্ষার্থী যে সম্পৃক্ত হতে পারছে না, তা স্বীকার করছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও।
তিনি বলেন, “টিভিতে ক্লাস নিচ্ছি আমরা, কিন্তু এটাও জানি এর মাধ্যমে সবাই কানেক্টেড হতে পারছে না। আর এটা কখনোই ট্রাডিশনাল স্কুলিং এর সমতুল্য হতে পারে না।”
এই পরিস্থিতিতে কী করণীয় ঠিক করছে সরকার- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বছর শেষে মূল্যায়ন করব। এর মাধ্যমে একটা চিত্র পাব।
“এর ভিত্তিতে আগামী বছরে আমরা সেটাকে কিভাবে স্কুল খুললে ম্যানেজ করব-ওইভাবে স্ট্রাকচার করব। এভাবে চালানো যাচ্ছে, চালাচ্ছি আমরা। চেষ্টা করছি। এ চেষ্টা সফল কি সফল না, এটা বোঝা যাবে যখন আমরা স্টুডেন্টের কাছে মূল্যায়ন করতে যাব।”
ক্ষতি পোষানোর পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ইয়ার রিপিটিশন করতে হবে। মানে ক্লাস সিক্সের এরা সেভেনে উঠে যাবে, কিন্তু সিক্সের পড়াটা সেভেনে আবার পড়তে হবে। স্কুল খোলার পর যে পড়াটা পড়ানো হয়নি, সে পড়াটা আবার পড়াতে হবে। সেভাবে করেই আমাদের আগামী পরিকল্পনাটা সম্পূর্ণ করতে হবে।”
চলতি বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, “উইন্টার সিজনটা যাওয়ার পর পরই আমরা স্কুল-কলেজ খোলার প্রক্রিয়া শুরু করব। উইন্টার সিজনটা আমরা অপেক্ষা করব।”