প্রথম ম্যাচে ৭-২-১৪-১, পরের ম্যাচে ৮-২-১৫-৩। এখনও পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট’স কাপের দুই ম্যাচে মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিং ফিগার। এই সংখ্যাগুলি যেমন স্বাক্ষ্য দিচ্ছে দারুণ কিছুর, ২২ গজে আসলে আরও ভালো ছিল তার বোলিং। তার গতি, নিশানা, স্কিলের প্রদর্শনী আর শরীরী ভাষা, সবকিছু থেকেই আশা করা যায়, সেরা ছন্দে ফেরার পথে আছেন এই বাঁহাতি পেসার।
প্রেসিডেন্ট’স কাপের পারফরম্যান্সকে বিবেচনার মানদণ্ড হিসেবে নিতে হলে অবশ্যই ভীষণ সাবধানী হতে হবে। বিসিবি যদিও এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ আনার চেষ্টায় কোনো কমতি রাখেনি। তারপরও আর দশটা টুর্নামেন্টের মতো লড়াইয়ের ঝাঁঝ থাকছে কিনা, সেই প্রশ্ন আছেই। এছাড়া, দীর্ঘ বিরতির পর ব্যাটসম্যানরা বেশির ভাগই নেই ছন্দে। শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে তাই মুস্তাফিজ পড়েননি এখনও। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটও তার বোলিংয়ের জন্য দারুণ সহায়ক।
ক্ষেত্র তাই মুস্তাফিজের জন্য প্রস্তুতই ছিল। তবে তৈরি মঞ্চেও নিজেকে মেলে ধরতে না পারার নজির তো অসংখ্য আছে। মুস্তাফিজ এবার পেরেছেন এখনও পর্যন্ত। তার চেয়েও বড় কথা, ইতিবাচক অনেক কিছুই চোখে পড়েছে তার বোলিংয়ে।
প্রতিপক্ষ বা উইকেট কিংবা পারিপার্শ্বিকতা, এসব তার হাতে নেই। নিজের করণীয়টুকু তিনি করেছেন দারুণভাবে।
ফিটনেসের কথা বলতে হয় সবার আগে। চার বছর আগে লন্ডনে কাঁধের বড় একটি অস্ত্রোপচারের পর থেকে চোট নিয়ে অনেক ভুগেছেন মুস্তাফিজ। ওই চোটের সঙ্গে সম্পর্কিত কিংবা অন্যান্য আরও ছোট-বড় চোট লেগেই ছিল। যেটিকে বলা হয় ‘নিগলস’, ক্রীড়াবিদদের অবধারিত নিয়তি, মুস্তাফিজের সেসব সবসময় ছিলই। শতভাগ ফিট হয়ে খেলতে পেরেছেন কম সময়ই।
কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে পাওয়া দীর্ঘ বিরতিতে যথেষ্ট বিশ্রাম পেয়ে মুস্তাফিজের শরীর ঝরঝরে দেখাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট’স কাপের দুই ম্যাচেই নিজের পুরোটা দিয়ে বোলিং করতে পেরেছেন বলে মনে হয়েছে মাঠের বাইরে থেকে দেখে।
পুরোপুরি ফিট বলেই হয়তো তার গতি দারুণ ছিল দুই ম্যাচে। স্পিড গান না থাকায় গতি মাপার উপায় ছিল না। খালি চোখে দেখে তা এই মন্থর উইকেটেও তার সেরা সময়ের কাছাকাছি মনে হয়েছে।
মুস্তাফিজের বোলিংয়ের গতি কতটা জরুরি, সেই আলোচনা হয়েছে বহুবার। গতি বেশি থাকলে তার কাটার কার্যকর হয় বেশি, ধন্দে পড়ে যান ব্যাটসম্যানরা। বৃহস্পতিবারের ম্যাচে নাজমুল হোসেন শান্ত যেমন পুরোই বিভ্রান্ত হয়েছেন কাটারে।
মুস্তাফিজের ক্ষুধা ও তাড়না নিয়েও প্রশ্ন উঠছিল কিছুদিন আগে। ক্রিকেট থেকে দীর্ঘসময় দূরে থাকার পর তাকে দারুণ ক্ষুধার্ত ও মেলে ধরার জন্য ধাবিত মনে হচ্ছে। প্রতিটি ওভারে, প্রতিটি বলে সেরাটা দেওয়ার তাড়না চোখে পড়েছে। মাঠেও খুব ফুরফুরে লাগছে তাকে।
এই দুই ম্যাচের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক, ব্যাটসম্যান বুঝে ও ফিল্ড পজিশন অনুযায়ী বোলিং করতে দেখা গেছে তাকে। অনেক সময়ই স্রেফ বোলিং করার জন্য বোলিং করে গেছেন, এমন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে। কিন্তু এই দুই ম্যাচে তার বোলিংয়ে পরিকল্পনার ছাপ চোখে পড়েছে স্পষ্ট।
দুই ম্যাচেই নতুন বলে দারুণ বোলিং করেছেন মুস্তাফিজ, সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন পুরোনো বলেও। সব স্পেলেই গতি ও ধার ছিল প্রায় একইরকম। কার্যকারিতাও তাই ছিল দারুণ। উইকেট তিনি সবসময়ই কম-বেশি পেয়ে আসছেন। কিন্তু টানা দুই ম্যাচে এমন ধারাল বোলিং করলেন হয়তো অনেকদিন পর।
প্রথম ম্যাচে তাদের দলের পুঁজি ছিল মাত্র ১০৩ রান। তবু মুস্তাফিজ ছিলেন উজ্জ্বল। দ্বিতীয় ম্যাচে পুঁজি মোটামুটি, মুস্তাফিজ ছিলেন আরও দুর্দান্ত। সতীর্থ বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম ৪ উইকেট নিয়েছেন, কিন্তু ১ উইকেট কম নিয়েও মুস্তাফিজ ম্যাচের সেরা বোলার হয়েছেন বেশি প্রভাব বিস্তারী বোলিং করায়।
এই দুই ম্যাচে তাকে নিয়ে একমাত্র হতাশার জায়গা, ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য ভেতরে আনা ডেলিভারি বা বাঁহাতির জন্য বাইরে, বহু চর্চিত সেই স্কিল রপ্ত করার প্রমাণ সেভাবে মেলেনি। বোলিং কোচ ওটিস গিবসন বারবার বলে আসছেন, এটি নিয়ে কাজ চলছে, মুস্তাফিজ উন্নতি করছেন। এই দুই ম্যাচে বা তার আগে দুটি দুই দিনের ম্যাচে বল পিচ করে টুকটাক সোজা হয়েছে বা দু-একবার ডানহাতির জন্য ভেতরে এসেছে বটে। তবে খুব আশা জাগানিয়া কিছুর ছাপ পড়েনি।
এটুকু বাদ দিলে আশার উপকরণ তার বোলিংয়ে অনেক ছিল। অবশ্যই এই দুই ম্যাচ দেখে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার কিছু নেই। লম্বা বিরতির পর কেবলই শুরু হয়েছে ক্রিকেট। এই টুর্নামেন্টে পথচলা বাকি আছে আরও, সামনে আছে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। জানুয়ারিতে হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পরীক্ষা। চ্যালেঞ্জ বাকি অনেক।
তবে ছোট ছোট উন্নতির পধ ধরেই তো বড় কিছুর দিকে ছুটতে হয়। মুস্তাফিজ পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন, প্রেসিডেন্ট’স কাপ থেকে এই আশা করতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট।