বিশ্বব্যাংকের সাম্প্র্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে তিন জনের একজন বেকার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের শ্রম জরিপ অনুযায়ী দেশে তরুণ বেকারের মধ্যে শতকরা ৪৬ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট। শুধু যে বেকার তা নয়, যারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছে তাদের বেশির ভাগেরই বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ যোগ্যতা ও দক্ষতা নেই বলে মাঝেমধ্যেই দৈনিক পত্রিকাগুলোতে খবর চাউর হয়। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের জরিপেও একই চিত্র দেখা যায়।
অথচ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রসারে ও জ্ঞান উৎপাদনে বর্তমানে মোট ১৫৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, ৫৩টি সরকারি আর বাকিগুলো বেসরকারি। এতগুলো প্রতিষ্ঠান থাকার পরও আমরা কেন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে পিছিয়ে। তাহলে কি বর্তমান ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ? যদিও অনেকেই বলেন সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা, আসলেই কি তাই? নাকি শুধুই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতা?
দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উল্লেখযোগ্য একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে—যুগোপযোগী পাঠ্যসূচি ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার। উন্নত দেশগুলোতে সমাজের আর যুগের চাহিদায় উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতি তিন/পাঁচ বছর অন্তর পাঠ্যসূচি/কর্মকৌশল আধুনিকায়ন করা হয়। বিষয়ভিত্তিক শিল্প ও শিক্ষা বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে অন্তত এক বছর চলে যুগোপযোগীর প্রক্রিয়া। এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। মূলত সমাজের চাহিদা আর শিল্পক্ষেত্র বিবেচনায় কর্মকৌশল তৈরি হয়। যে কোনো বিষয়ে তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি প্রায়োগিক দিকটির প্রাধান্য বেশি থাকে, যাতে করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে ওঠে। পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতিও হয় স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত, যাতে মেধার সঠিক প্রতিফলন ঘটে।
অন্যদিকে, পাঠ্যসূচির আধুনিকায়ন ও পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠদের মতামতই চূড়ান্ত। যেহেতু বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষমতা অসীম, নবীন কেউ পরিবর্তন করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তার অবস্থা অনেকটা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। কেন না চাকরি স্থায়ীকরণ আর পদোন্নতি জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের মেজাজ-মর্জিও ‘নেক নজরের’ ওপর শতভাগ না হলেও ৯০ শতাংশ নির্ভরশীল। কিছুদিন আগে কথা হয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে, দুই জনের মুখেই হাহাকার, তাদের পাঠ্যসূচি নিয়ে। অনেকেই নাকি এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে উত্সাহী হয় না! মানসিকতাও একটা ব্যাপার, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকেই নতুন কিছু গ্রহণ করতে নিজেও আগ্রহী হয় না, অন্যকেও উত্সাহিত করে না। কারণ এতে ‘তাদের’ পরিশ্রম বেড়ে যায়! বেশি আগ্রহী সান্ধ্য প্রোগ্রামে বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোতে, কেননা এতে অল্প পুঁজি বেশি রুজি! ফলে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতার চর্চা তো হয়ই না, উপরন্তু নতুন নতুন বিভাগ/প্রতিষ্ঠান খুলে ‘নতুন বোতলে পুরোনো পানি’ ঘটনাই বেশি। যতদূর জানা যায়, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচি/কর্মকৌশল যুগোপযোগী নয়, বরং বিশ্বের ও দেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় খুবই বেমানান।
ইউজিসির ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মাত্র ১১ শতাংশ (৪০ লাখের) শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৃষিশিক্ষায় আর সবচেয়ে বেশি (৫৮ শতাংশ) মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানে। তার মানে কি আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছি? যদিও বিশ্ববিদ্যালয় অনুসারে মাথাপিছু ব্যয় একেক রকম, উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে গড়ে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়, শিক্ষার্থী প্রতি যার মূল জোগানদাতা হচ্ছেন সাধারণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। উন্নত বিশ্বের তুলনায় ব্যয়ের পরিমাণ যত্সামান্য মনে হলেও, দেশের প্রেক্ষাপটে মোটেই কম নয়। তাহলে কেন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না? কারণ অন্যান্য খাতের মতো এখানেও আমরা রোগের কারণ খুঁজি না, খুঁজি গোঁজামিলের কৌশল। সরকারের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় এবং জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের কি চাহিদার অতিরিক্ত দক্ষ মানবসম্পদ থাকা উচিত নয়? অবশ্যই, কিন্তু আমরা যে দ্রুত সবকিছুতে ‘রাজনীতির’ রং জুড়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। অথচ সৃজনশীলতার নামে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা, ফলাফল যেই লাউ সেই কদু!
একটা শিক্ষানীতি হয়েছিল ২০১০ সালে যার বাস্তবায়ন কবে হবে কেউ জানে না। শোনা যাচ্ছে, উক্ত নীতির সংশোধন হবে, খুবই ভালো কথা কিন্তু সংশোধিত নীতিতে কি কর্মমুখী শিক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্ব থাকবে? থাকবে কি সমাজের/শিল্পের চাহিদা মোতাবেক শিক্ষার রোডম্যাপ? আপাতদৃষ্টিতে, সবক্ষেত্রে ‘রাজনীতিকরণ’ এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা—মানি আর না মানি। ফলে তৈরি হচ্ছে পাপিয়া, মালেক, শাহেদ, সাবরিনাদের, শিক্ষায়ও রয়েছে এমন অনেক ‘শাহেদ’, যাদের কাজ পড়ানো বা জ্ঞান তৈরির পরিবর্তে ‘অন্যকিছু’। এতে ধ্বংস হচ্ছে নীতি-নৈতিকতার ও সামাজিক মূল্যবোধের। দ্রুত বাড়ছে সর্বক্ষেত্রে ‘তথাকথিতদের আধিক্য এবং দৌরাত্ম্য। এমতাবস্থায়, দেশের শিল্পের চাহিদা মেটাতে দক্ষ মানবসম্পদ আমদানি করতে হচ্ছে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও কোরিয়া থেকে। আহারে এত মানুষও উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থাকার পরেও দক্ষ মানবসম্পদের কী দুর্গতি—ভাবা যায়?
আমরা যে কোনো বিষয়ে ‘চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে’ ধরনের আচরণে বেশি অভ্যস্ত। কোনো বিষয়ে শোরগোল শুরু হলেই অমুক করা উচিত ছিল, তমুক করলে ভালো হত ইত্যাদি বাগিবতণ্ডা চলতেই থাকে, অগত্যা ফলাফল শূন্য। মনে রাখা উচিত, পথভ্রষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল দৃষ্টিগোচর হতে সময় লাগে, আর যখন হয় তখন সময় থাকে না, গুনতে হয় চরম মূল্য। এটা অনেকটা নদীকে বাঁধবন্দি করার মতো, তাত্ক্ষণিক ফল প্রত্যাশার অতিরিক্ত দীর্ঘমেয়াদে কিন্তু পুরোপুরি উলটো।
দিনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা দেশ সয়লাব হচ্ছে কিন্তু জ্ঞানবিজ্ঞানের উত্কর্ষে সময়ের/শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী বিভাগ খোলা হচ্ছে না। তাছাড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শিক্ষার্থীও কম। এমন অবস্থা চলতে থাকলে একসময় হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানোর জন্য ‘যোগ্য’ শিক্ষকই পাওয়া যাবে না। তাই যুগের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে জনবল তৈরি করা উচিত তা না হলে অনিশ্চিত গন্তব্য শুধু দেশের বোঝাই বাড়াবে, সমাজের বা মানুষের কল্যাণে আসবে না। আমাদের আত্মনির্ভরশীলতার জন্য উচিত উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার ও আধুনিক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, যা শুধু দেশের মঙ্গল বয়ে আনবে না, নিশ্চিত করবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও টেকসই উন্নয়নে।
ড. আশরাফ দেওয়ান
লেখক : অধ্যাপক, স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সাইন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া