ছিলেন একজন ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান

Ustad_shahadat-291120-01

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান চলে গেলেন করোনাভাইরাসের থাবায়।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে সারাবিশ্ব আজ টালমাটাল। একে একে চলে যাচ্ছেন অভিভাবকসম ব্যক্তিত্ব। পৃথিবী হারাচ্ছে অমূল্য সম্পদ। কিংবদন্তী সমতূল্য মানুষ। তাদেরই একজন ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান।

শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি৷ মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর৷ এই শিল্পীকে নিয়ে লিখলেন আরাফাত শান্ত।

তিনি অসুস্থ ছিলেন শুনেছিলাম, সুস্থও হচ্ছেন বলে খবর পেলাম এর ভেতরেই অবস্থার অবনতি ঘটে, তিনি কাল চলেই গেলেন।

আমাদের মিডিয়োক্রিটির জীবনে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানদের অবস্থান কিছুটা দূরে। তাই তাদের মতো মানুষদের নিয়ে আমাদের চেনা জানাও কম। আর ক্লাসিক্যাল সংগীত নিয়ে আমাদের যে জাতিগত উন্নাসিকতা আছে তাতে শাহাদাত হোসেন খান আমাদের গণ্ডির বাইরের মানুষ।

এটা ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানও স্বীকার করতেন।

তিনি বলতেন, “উপমহাদেশে খুবই অল্প শ্রোতাই উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনেন, বাংলাদেশে তা আরও কম। আমাদের শিক্ষাদীক্ষার যে হাল।”

তবুও ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান বসে ছিলেন না। তিনি সরোদ হাতে নিয়ে কত অনুষ্ঠান করেছেন দেশে বিদেশে, ভারতেও তার জনপ্রিয়তা ও তাকে নিয়ে চর্চা কম নয়। তবুও তিনি আমাদের জন্য রইলেন অচেনাই।

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেনকে চিনতে হলে আমাদের চিনতে হবে দুই ভাইকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্ম নেওয়া দুই বিশ্ব বরেণ্য ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ আর ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান হলেন ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ এর নাতি।

তার পিতা ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান একজন প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী ও সেতারবাদক। তার দাদা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ছোট ভাই। তার দুই চাচা প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ বাহাদুর হোসেন খান এবং সংগীতজ্ঞ গবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন খান।

শাহাদাত হোসেন খান ১৯৫৮ সালের ৬ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এক সমৃদ্ধ সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ এর হাতেই তার সরোদের হাতেখড়ি হয়। দাদার বানানো সরোদেই তার সংগীত শিক্ষা শুরু।

কিছুদিন পরেই তার দাদা আয়েত আলী খাঁ সাহেব মারা যান। আয়েত আলী খাঁও একজন অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ। এখনকার যে সরোদটা আমরা দেখি তা উনার সৃষ্টি। উনি নানান যন্ত্র বানাতেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ যখন ইউরোপ ট্যুরে ছিলেন তখন তিনি একটা নকশা পাঠিয়েছিলেন যে এটা বানানো যায় কি না। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ তা বানিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘মন্দ্রনাথ’, যেটা কিছুটা আধুনিক যন্ত্র ‘চেলো’র মতো।

১৯৭২ সালে তিনি ও তার চাচা বাহাদুর হোসেন খান যুগলবন্দি হয়ে আলাউদ্দিন সংগীত সম্মেলনে সরোদ পরিবেশন করে প্রশংসিত হন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাইহারে গিয়ে সেখানে মাইহার ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেন।

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান সেই ঘরানাতেই ছিলেন। সেই ঘরানাতেই আজীবন চর্চা করে গেছেন। যদিও তিনি ঘরানার যে অবলুপ্তিতে তাতে কষ্ট পেতেন। কারণ এখনকার যন্ত্রসংগীত শিল্পীরা শ্রোতার ভালো লাগার কথা চিন্তা করে বিভিন্ন ঘরানার ভালো ভালো আলাপ ও তান নিয়ে একটা মিশ্রণ বানান।

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খাঁন সরকারী আমলা ছিলেন। সংগীত কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু নিবিষ্ঠ চিত্তে একটা কাজই করেছেন সেটা হল উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা।

তাদের একটা স্কুল আছে আয়েত আলী খাঁ এর নামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ভেবেছিলেন, এবার নতুন নতুন শহরে প্রচুর শ্রোতাদের শোনানো যাবে। শো’ও করতেন নিয়মিত ইউরোপ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়।

কিন্তু মাত্র ৬২ বছর বয়সেই আমাদেরকে আরও অনেক কিছু শোনানোর আগেই তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন। তার স্ত্রীরও এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।

ছেলে মেয়েদেরও তিনি সরোদ সেতারের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি সব সময় চাইতেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাদের এই সংগীতে যে অগ্রগামিতা তা বহন করুক।

১৯৯৪ সালেই তিনি একুশে পদক পেয়েছেন। তার চাচা মোবারক হোসেন খান বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ তিনিও একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। তার দাদাও পাকিস্তানের বেসামরিক শ্রেষ্ঠত্বের পুরষ্কার প্রাপ্ত।

পুরষ্কার তাদের জন্য খুবই সাধারণ। কিন্তু তার মতো মানুষের চলে যাওয়া আমাদের এই ক্ষয়িষ্ণু মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য বিশাল বড় ক্ষতি!

Pin It