করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) উদ্বৃত্ত বেড়েই চলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুধবার হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৫ কোটি ৪০ লাখ (৪.০৫ বিলিয়ন) ডলার। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৫৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে কোনো উদ্বৃত্ত ছিল না; বরং ১৫২ কোটি ১০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল।
এই বড় উদ্বৃত্তে স্বস্তি দিলেও মহামারীর প্রকোপ ফের বাড়তে থাকায় তা কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির গবেষকরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে।
“এই অবস্থা চলতে থাকলে লেনদেন ভারসাম্যসহ অর্থনীতিতে যে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছিল, তা হোঁচট খেতে পারে।”
২০০৭-০৮ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই কঠিন সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত খুবই ভালো।”
নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় উদ্বৃত্ত হওয়ার পেছনে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার ভূমিকা রয়েছে।
পাশাপাশি মহামারীর মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি অনেক কমে যাওয়াও রেখেছে ভূমিকা, যা অর্থনীতির স্থবিরতার দিকটিও দেখিয়ে দেয়।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, “প্রণোদনা প্যাকেজসহ সরকারের নানা তৎপরতায় মনে হচ্ছিল, মহামারীর সঙ্কট খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠবে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেটা দীর্ঘ হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৪৮৪ কোটি ৯০ লাখ (প্রায় ৫ বিলিয়ন) ডলারের বড় ঘাটতি নিয়ে।
তার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি, ৫১০ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত
আমদানি কমায় নতুন শঙ্কা
ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় উদ্বৃত্ত থাকা অর্থনীতির জন্য স্বস্তির হলেও সার্বিক বিবেচনায় আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বিচক্ষণতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার উপর জোর দিয়েছেন আহসান মনসুর।
তিনি বলেন, “আগামী দিনগুলোতে রেমিটেন্সে খুব ভালো খবর আসবে বলে আমার কাছে মনে হয় না। রপ্তানির ক্ষেত্রেও একই শঙ্কা আছে। অন্যদিকে আমদানি খরচ বেড়ে গেলে এই উদ্বৃত্ত থাকবে না।”
মির্জ্জা আজিজ বলেন, “কোভিড-১৯ বিশ্ব অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে; এখনও দিচ্ছে। এর শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না। এখন খুব সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে আমাদের। আত্মতুষ্টিতে না ভুগে, বিশ্ব পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
বাণিজ্য ঘাটতি অর্ধেক
প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ করেছিল বাংলাদেশ।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে তা কমে ৩২৩ কোটি ৬০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারে নেমে এসেছে।
গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ৫৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ এক হাজার ২৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় করেছে। আর আমদানিতে ব্যয় করেছে এক হাজার ৫৭৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
এ হিসাবেই এই তিন মাসে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
এই চার মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ। আর আমদানি ব্যয় কমেছে ১৩ শতাংশ।
সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও অর্ধেক
গত বছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সেবা খাতে ঘাটতি ছিল ১১১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর এ বছরের একই সময়ে তা কমে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।
মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
রেমিটেন্স বেড়েই চলেছে
অর্থবছরের চার মাসে ৮৯৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছর এই চার মাসে পাঠিয়েছিলেন ৬৩০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪২দশমিক ১৬ শতাংশ।
নভেম্বরে ২০৮ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা, যা গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও উদ্বৃত্ত
করোনাভাইরাস মহামারীকালে সঙ্কট কাটিয়ে প্রায় পুরোপুরি সচল হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি: সুমন বাবুকরোনাভাইরাস মহামারীকালে সঙ্কট কাটিয়ে প্রায় পুরোপুরি সচল হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি: সুমন বাবু
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
২০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের চার মাসে অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৪১৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত রয়েছে।
গত বছরের এই চার মাসে ২২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল।
আর্থিক হিসাবেও উদ্বৃত্ত
আর্থিক হিসাবেও (ফাইনানশিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্তে চলে এসেছে বাংলাদেশ।
অর্থবছরের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৭৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল। চার মাসে অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে তা ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার উদ্বৃত্তে চলে এসেছে।
গত বছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ১৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
বিদেশি ঋণ-সহায়তা বেড়েছে ৮৩%
চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ১৬৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত বছরের এই চার মাসে এসেছিল ৯০ কোটি ১০ লাখ ডলার।
শতকরা হিসাবে এই চার মাসে বিদেশি ঋণ-সহায়তা বেড়েছে ৮৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
আহসান মনসুর বলেন, করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার মোটা অংকের ঋণের কারণে আর্থিক হিসাবেও উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
এফডিআই কমেছে ৩১%
ঋণ-সহায়তা বাড়লেও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৭২ কোটি ডলারের এফডিআই পেয়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের একই সময়ে পেয়েছিল ১০৪ কোটি ডলার। এ হিসাবে এই চার মাসে এফডিআই কমেছে ৩০ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এই সময়ে নিট এফডিআই এসেছে ১৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
এ হিসাবে নিট এফডিআই কমেছে ৫০ দশমিক ১৬ শতাংশ।