বাংলাদেশ চলতি বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। ঐ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিতে যায় ভারতও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানজুড়ে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা দেয়, তা প্রশমনের জন্য তিনি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের অপর দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি তোয়ায়েল আবদুর রহমান। তবে এই কমিশনের রিপোর্টটি ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছিল পাকিস্তান।
জানা গেছে হামুদুর রহমান কমিশন প্রথম পর্বে সাবেক, বহাল সামরিক কর্মকর্তাসহ ২১৩ জনের জবানবন্দি নেয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া, জুলফিকার আলী ভুট্টো, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান। দ্বিতীয় পর্বে ভারতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক সেনা কর্মকর্তাসহ ৭২ জনের জবানবন্দি নেওয়া হয় দেশে ফিরে যাওয়ার পর, যাঁদের মধ্যে জেনারেল নিয়াজি, রাও ফরমান আলীও ছিলেন। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি কমিশন সেনা কর্মকর্তাদের নৈতিক ও চারিত্রিক দুর্বলতাগুলোও তুলে ধরেছে এবং একটি আধুনিক পেশাদারি বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু সুপারিশ করেছে।
ঐ অনুসন্ধানে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতা অপব্যবহারের কথা তুলে ধরা হয়। এছাড়াও হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে পাকিস্তানের বেশ কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়।
স্বাধীনতার ৫০ বছর: যা ছিল হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে
হামুদুর রহমান কমিশন গণহত্যার বিষয়টি আমলে না নিলেও সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হিসেবে সেনা কর্মকর্তাদের নৈতিক স্খলন, চারিত্রিক দুর্বলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা ও সাক্ষীদের বক্তব্য নিয়েছে। কমিশন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে তিন ধরনের অভিমত দিয়েছে। রিপোর্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাপুরুষোচিত আচরণ, দুর্নীতি, বাঙালির ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড, বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানদের হত্যা, লুট, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন, হিন্দু হত্যা ইত্যাদির নাতিদীর্ঘ বর্ণনা আছে। আছে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথাও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কমিশন মাত্র ১২ কপি রিপোর্ট তৈরি করেছিল, যার একটি দেওয়া হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে। তিনি এই রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করেননি। বরং নিজের কাছে একটি কপি রেখে বাকিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছেন। ভুট্টো ভেবেছেন, রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সেনাবাহিনী নৈতিকভাবে আরও ভেঙে পড়তে পারে এবং অসম্মানিত হতে পারে। এ ছাড়া রিপোর্ট প্রকাশ না করার আরেকটি কারণ হলো কমিশন মৃদুস্বরে হলেও তাঁর সমালোচনা করেছে। ১৯৭৫ সালে ভুট্টো প্রধান বিচারপতিকে জানান, রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে হয় হারিয়ে গেছে অথবা কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর প্রধান বিচারপতি সেনাপ্রধান জিয়াউল হককে প্রকাশ করতে বললে তিনিও একই জবাব দেন। । ২০০০ সালে এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ ফাঁস হয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
জেনারেল নিয়াজি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টকে প্রহসন হিসেবে উল্লেখ করে আরেকটি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর এই কমিশন গঠনের এখতিয়ার নেই। কেননা, তিনি নিজেই পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংস ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য দায়ী।
ভুট্টোর অনুরোধেই ১৯৭১ সালে ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে এ কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয় ১৯৭৪ সালের ২৩ অক্টোবর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের কারণ হিসেবে পাকিস্তানের নৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে কমিশন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে পুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি আওয়ামী লীগকে। হামুদুর রহমান কমিশন তাদের প্রতিবেদনে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা কেন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সামরিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছিলেন তার রাজনৈতিক কারণও ব্যাখ্যা করে।