স্বাধীনতার ৫০ বছর: বাংলাদেশে মোহাম্মদ আলী

IMG_20160607_160521

গ্যালারিঠাসা ঢাকা স্টেডিয়াম (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম)। মাঝখানে বসানো বক্সিং রিং। কিংবদন্তী মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর মুখোমুখি ১২ বছর বয়সী মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন!

লড়াই চলছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাউন্ড। রেডিও ও টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। প্রতি রাউন্ড তিন মিনিটের। পরের রাউন্ডের লড়াই শুরুর আগে ১ মিনিটের বিরতি।

তৃতীয় রাউন্ডে একটা পর্যায়ে রিংয়ে পড়ে গেলেন মোহাম্মদ আলী। রেফারি এম এ মতিনের কাউন্ট ডাউন শুরু …ওয়ান, টু, থ্রি…নাইন। উঠে দাঁড়ালেন আলী। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় দিলেন গর্জনও। নির্ভয়ে আলীকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত ১২ বছরের কিশোর গিয়াস!

বাংলাদেশের লাখো-লাখো মানুষের স্মৃতিতে এই ঘটনা এখনও টাটকা। ৪৩ বছর আগে ঢাকায় বাংলাদেশের এক ক্ষুদে বক্সারের সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর ১২ মিনিটের এ লড়াই বক্সিং ইতিহাসে হয়ত কোন গুরুত্বই বহন করে না। রেকর্ডের পাতাতেও নাই। এটা যেমন সত্যি, তার চেয়েও বড় সত্যি বক্সিং ইতিহাসের বহু বড়-বড় রেকর্ড মানুষ ভুলে গেলেও এই ‘১২ মিনিট’ যুগ যুগ ধরে পরম যত্নে স্মৃতির মণিকোঠায় আগলে রেখেছেন এদেশের লাখো মানুষ।

২০১৬ সালের ৩ জুন ইহলোকের মায়া কাটান দীর্ঘদিন ধরে পারকিনসন রোগে ভোগা আলী। ওই সময় দুই ভারতীয় সাংবাদিক যোগাযোগ করেন গিয়াসের সঙ্গে। এদের একজন চেন্নাইয়ের; অন্যজন কলকাতার। ১২ মিনিটের সেই লড়াই নিয়ে অনেক কথাই বলেন প্রতিবেশী দেশের ওই দুই সাংবাদিক। বাসাবোয় নিজের ব্যবসায়ীক কার্যালয়ে বসে সে সব দিনের স্মৃতি আওড়াতে থাকেন গিয়াস। একটা পর্যায়ে কলকাতার সাংবাদিক যখন জিজ্ঞাসা করলেন, আলীর শেষকৃত্যে যেতে চান না? গিয়াস নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না, “এই সংবাদ শোনার পর আমার বুকটা ভেঙে গেছে। মনে হচ্ছিল, আমার পাজরের একটা হাড় খসে পেড়ে গেছে। উনার শেষ কাজের সময় থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে সামর্থ্য কিংবা যোগাযোগ তো আমার নাই।”

মোহাম্মদ আলীর ঢাকা আসা প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কামরুজ্জমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনিও তুলে ধরলেন নানা মজার ঘটনা, “আমার জানামতে, উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আসেন মোহাম্মদ আলী। মনে রাখতে হবে ওই সময় আলী খেলার মধ্যে ছিলেন। বাংলাদেশে আসার মাত্র তিন দিন আগে লিওন স্পিংকসের কাছে খেতাব হারান। এর কয়েক মাস পর স্পিংকসকে হারিয়ে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন মোহাম্মদ আলী।”

শুধু সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধাই নন, আলী শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ। মাঠের লড়াইয়ে থাকা আলীর কোন দেশ সফর মানে বিশাল কিছু। আর মাত্র সাত বছর বয়সী ‘শিশু বাংলাদেশের’ জন্য এটা যে কত বড় ঘটনা, তা ভাষায়ও প্রকাশ করা যায় না-বিষয়টাকে এভাবেই মূল্যায়ন করলেন বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান।

চ্যাম্পিয়ন মুষ্টিযোদ্ধার বাংলাদেশ সফরের সময় কামরুজ্জামান ছিলেন ব্যস্ত সাংবাদিক। আলীকে একনজর দেখার জন্য ঢল নেমেছিল মানুষের। তেজগাঁও বিমানবন্দরে শুধু মানুষ আর মানুষ। বিমানবন্দর সংলগ্ন রাস্তাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। মানুষের স্রোত যেন থামার নয়। শতাব্দীর সেরা এই ক্রীড়াবিদকে দেখতে কত মানুষ জড় হয়েছিল? ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস পত্রিকার মতে, সেদিন আলীকে একপলক দেখতে এসেছিল ২ মিলিয়ন (২০ লাখ) মানুষ!

একটি প্রামাণ্যচিত্রের জন্য লন্ডনভিত্তিক সেভেন গ্রুপের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন মোহাম্মদ আলী। সঙ্গে ছিলেন তার মা, ভাই, স্ত্রী ভেরোনিকা পোরশিয়া, সন্তান লায়লা আলীসহ পরিবারের ৯ জন সদস্য। একটা পর্যায়ে বক্সিং কিংয়ের বাংলাদেশ সফর নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। স্পিংকসের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষত তখনও তার শরীরে। সব শঙ্কা, অনিশ্চয়তা পেছনে ফেলে এলেন দ্য চ্যাম্পিয়ন। প্রথম সংবাদ সম্মেলন হলো বিমানবন্দরেই। ছোট্ট জায়গা। ৩০/৪০ জনের স্থান সংকুলান সম্ভব। কিন্তু উপস্থিত সাংবাদিকের সংখ্যা একশোর কম হবে না। কামরুজ্জামানের ভাষায়, “আমাদেরই তো দাঁড়ানোর মতো জায়গাই ছিল না!”

বেশ কিছু উদ্ভট প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হল আলীকে। প্রেসক্লাবে আড্ডায় হাসতে হাসতে কামরুজ্জামান বললেন, “সকালের নাস্তায় একটা খাসি কিংবা লাঞ্চ/ডিনারে একটা আস্ত গরু খান কিনা, এমন প্রশ্নও করা হয়েছে তাকে।” জানতে চাইলাম, জামান ভাই আপনি কী প্রশ্ন করেছিলেন? উত্তরে বললেন, “এটারও একটা ঘটনা আছে। ওই সময় ভয়েজ অব আমেরিকা’র সংবাদে জানতে পারলাম, আলী-জো ফ্রেজিয়ারের মধ্যে আর একটা লড়াই আয়োজনের উদ্যোগ চলছে। এই জায়গাটা থেকেই প্রশ্নটা করেছিলাম। উত্তরে আলী বললেন, এটা আর সম্ভব নয়। আমরা তিনবার মুখোমুখি হয়েছি। একবার জিতেছে ফ্রেজিয়ার। আর বাকি দুবার জিতেছি আমি। দুজনের মধ্যে চতুর্থ লড়াই আর হবে না।”

মোহাম্মদ আলীর সফর ছিল ৫ দিনের। প্রথম দিনেই রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা পদ্মায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যান নৌবিহারে। স্টিমারে করে ঘুরে আসেন বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা ও ধলেশ্বরী। পরদিন ঘুরতে চান সিলেটের খাদিমপুর চা বাগান। ওইদিন বিকালে ঢাকা স্টেডিয়ামে তাকে দেয়া হয় নাগরিক সংবর্ধনা। একইসঙ্গে আয়োজন করা হয় প্রদর্শনীমূলক মুষ্টিযুদ্ধের। আলী জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোন পেশাদার বক্সারের সঙ্গে ফাইট করবেন না। তার ইচ্ছাকে সম্মান দিয়ে, ১২ বছরের কৈশোরে পা রাখা গিয়াসকে প্রস্তুত করা হয়।

ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে গিয়াস বলেন, মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে ফাইট করব, আমার ভিতরে যে কী চলছে ভাই, বলে বুঝাতে পারব না। ওই ঘটনার কথা মনে হলে, আমি এখনও কেঁপে উঠি। প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। তবে রিংয়ে নামার পর ভয় কেটে গেল। আলী পুরো সময়টাই কৌতুক করেছেন। উনার মুখ পর্যন্ত আমার ঘুষি পৌঁছাচ্ছিল না। আমি তো বাচ্চা! আর উনি ৬ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা। নাগাল পাব কীভাবে? উনার পেট বরারর ঘুষি মারার চেষ্টা করছিলাম। দু একটা ঘুষি লাগছিল কি লাগছিল না, উনি পড়ে যাওয়ার ভান করলেন। এই ১২ মিনিট আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। শুধু আমার নয়, আমার পরিবারেরও সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”

ওই বক্সিং রিংয়ে ঘটে আর একটি ঘটনা। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা চেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে লড়াই করবেন ‘বাংলার আলী’খ্যাত আব্দুল হালিম। সেটি হয়নি। তবে মোহাম্মদ আলীর সান্নিধ্য পান আব্দুল হালিম। গ্রেট আলীর সঙ্গে ছবিও তোলেন । বাংলার আলীর ভাষ্যে, “সেদিন ছিল রোববার। ওই সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল রোববার। লোকে লোকারণ্য। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভীষণ কড়া। কর্তৃপক্ষ ও সাংবাদিকদের সহায়তায় মঞ্চে উঠলাম। সাংবাদিকরা উনাকে আমার সঙ্গে ছবি তোলার অনুরোধ জানালেন। বললাম, আমি একজন বক্সার। উনি হঠাৎ রেগে গেলেন। ফটো সাংবাদিকদের ইশারায় ছবি তুলতে না করলেন। কিছুটা ভড়কে গেলাম। মনে মনে ভাবছি, কোথাও কি ভুল করলাম? এমন সময় আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ঘুষি মারার পোজ দিলেন। সেই মুহূর্তে ছবি তোলা হল। এমন মাটির মানুষ হয় না। বক্সার আলীর সঙ্গে আমার ছবি, এর চেয়ে জীবনের বড় প্রাপ্তি আর জীবনে আর কি আছে!”

ওই সফরে আলীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। উদ্বোধন করেন বক্সিং স্টেডিয়ামের। মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম তার উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আজও। সফরের তৃতীয় দিন ২০ ফেব্রয়ারি আলী বেড়াতে যান কক্সবাজার ও পতেঙ্গা। কক্সবাজারের কলাতলীতে তাকে এক খণ্ড জমি দেয়া হয়। পরদিন ফেরেন ঢাকায়। বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যান। শ্রদ্ধা জানান ভাষা শহীদদের।

বাংলাদেশকে গ্রেট আলী কতটা আপন করে নিয়েছিলেন, তা তার দুয়েকটা কথা থেকেই স্পষ্ট। বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “স্পিংকস তুমি যার সঙ্গে লড়াই করতে এসেছ, সে এখন আগের চেয়েও শক্তিশালী। এখন থেকে আলী একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের নাগরিক।” বাংলাদেশের মানুষকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন আলী। কয়েকমাসের মধ্যেই স্পিংকসকে হারিয়ে ফিরে পেয়েছিলেন হারানো মুকুট। বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন, “স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশে যাও।”

বক্সিং রিংয়ে আলী কেমন ছিলেন? এক কথায় উত্তর, প্রজাপতির মতো নেচে নেচে মৌমাছির মতো হুল ফুটাতেন। বক্সিংকে উন্নীত করেন শিল্পের পর্যায়ে। শুধু এটুকু বললে মোহাম্মদ আলী নামের মাহকাব্যটি থেকে যাবে অসম্পূর্ণই। খেলার মাঠে অনেক কিংবদন্তী এসেছেন, ভবিষ্যতেও আসবেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলী যে একজনই।

১৯৬৭ সালের ২৮ এপ্রিল তারিখটি বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে এক জ্বলজ্বলে দিন। সামরিক প্যানেলের সামনে তলব করা হলো তাকে। টেক্সাসের হিউস্টন ট্রাইব্যুনালের সামনে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন আলী। কেন যুদ্ধে যেতে চান না, তাও স্পষ্ট করে দেন, নিজের দেশ থেকে দশ হাজার মাইল দূরে গিয়ে আমি কেন বোমা আর গুলি চালাতে যাব। যারা কোন অন্যায় করেনি? পড়লেন এরপর রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষানলে। কেড়ে নেয়া হলো তার চ্যাম্পিয়নশিপ। শুরু হলো পদে পদে হেনস্থা। ওই সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চান কি-না? দৃঢ়ভাবে না বলেছিলেন, “আমি কোনদিনই দেশ ছাড়ব না। এখানে যে ২ কোটি ২০ লাখ কালো মানুষের মুক্তি, ন্যায়বিচার আর সমতার যে সংগ্রাম, তাতে আমি অনেক সাহায্য করতে পারি।”

একজন আলীর পক্ষেই সম্ভব রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে নিপীড়িত মানুষের হয়ে কথা বলা। আবার বক্সিং রিংয়ে নেমে ছোট বাচ্চা ছেলের ঘুষি খেয়ে নকআউট হওয়ার ভান করা। আলী প্রায়শই বলতেন, ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল। কালো অবশ্যই সুন্দর। কেননা, কালো মানুষের গৌরব নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যে কোনদিনই হার মানেননি আলী।

বাংলাদেশের হালিম ও গিয়াসের ভাষায়, মোহম্মদ আলী মাটির মানুষ। কালো মাটিতে গড়া কালো মানুষ। জগৎ সংসারের সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় আধার যে কালো মাটি !

নাজমুল হক তপন

Pin It