কেনো বারবার লাশ টুকরো করা হচ্ছে ?

image-248384-1622562827

‘মানুষের যখন নৈতিকতার অবক্ষয় হয়, তখন সে অসহিষ্ণু হয়ে উঠে। আর অসহিষ্ণু মানুষের ব্রেনের বিচারিক সেলগুলোর কার্যকারিতা কমে যায়। তখন সে হিংস্র হয়ে পড়ে। একজন হিংস্র মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে।’

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো টুকরো করার মনস্তাত্ত্বিক কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইত্তেফাকের কাছে এমন মন্তব্য করেছেন মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল। তার মতে, ‘একজন মানুষ অপরাধ করার পর তার ব্রেনে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি কাজ করে না। ফলে সে নিজের অপরাধ ঢাকতে আরো বেশি নৃশংস হয়ে পড়ে। এটা একজন অপরাধীর সহজাত প্রবণতা। এটা সামাজিক অবক্ষয়ের ফল।’

সর্বশেষ গত রবিবার বনানীতে স্ত্রীকে না জানিয়ে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীকে হত্যার পর লাশ ছয় টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেয় স্ত্রী। এর আগে রাজধানীর দক্ষিনখানে মসজিদের ইমামের সঙ্গে পরকীয়ার জেরে স্ত্রী ও ইমামের পরিকল্পনায় ইমাম স্বামীকে হত্যার পর ছয় টুকরো করে সেফটি ট্যাংকে ফেলে দেয়। গত মার্চে পারিবারিক কলহের জেরে গাজীপুরে স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহ সাত টুকরো করে স্বামী। এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই। গত এপ্রিলে ভারতের ধারওয়াড়ে নিজের ভাইকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করেন জনপ্রিয় নায়িকা শানায়া কাটওয়ে। পরে তিনি গ্রেফতার হন।

মানুষের এই হিংস্রতার প্রবণতা নিয়ে বলতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করিম ইত্তেফাকে বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনাগুলোর অধিকাংশ দেখা যায় অবৈধ সম্পর্কের ফলেই হচ্ছে। এছাড়া ক্ষোভ ও বঞ্চনা থেকেও অনেকে নৃশংস হয়ে উঠেন। আসলে মানুষের অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন একটা সহজাত প্রবণতা। আমাদের দেশে এটা নিয়ে খুব একটা গবেষণা নেই। তবে ভারতের একটা গবেষণায় দেখা গেছে, ওদের ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই কমবেশি অবৈধ সম্পর্কে যুক্ত। এখন এই ধরনের সম্পর্কে যুক্ত মানুষ নিজেকে লুকিয়ে কাজটা করতে চায়। এটা যখন ধরা পড়ে তখন সে নিজেকে বাঁচাতে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। আর একবার অপরাধের পথে পা বাড়ালে তখন তার মধ্যে কোন ধরনের মানবিকতা কাজ করে না। একাধিক অপরাধ সে করে ফেল।’

অপরাধ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিয়া আহমেদও ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা এক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন আমরা সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায়ও নেই, আবার আধুনিক সমাজের সঙ্গে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারিনি। ফলে মাঝামাঝি একটা অবস্থায় আছি। ইউরোপ-আমেরিকার মতো আধুনিক ব্যবস্থায় যেতে পারলে অবৈধ সম্পর্কগুলো নিয়ে এত লুকোচুরি হতো না। আজ কাউকে ভালো লাগেনি, তো তাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে চলে যাচ্ছে তারা। আমরা তো এখনও সেটা পারছি না। ফলে এই সম্পর্কগুলো লুকিয়ে হচ্ছে। কয়েকবছর আগে দেখবেন, মা অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত অবস্থায় ছেলে দেখে ফেলায় মোহাম্মদপুরে ছেলেকে হত্যা করেন মা। আবার স্বামী বা স্ত্রী কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করছেন লুকিয়ে। সেটা কেউ দেখে ফেললে নিজেদের বাঁচাতে তারা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার করোনায় বন্দি থাকার ফলেও অনেক সময় আমাদের মনস্তত্ত্বেও পরিবর্তন আসছে। পরিবারে বিনা কারণে বিবাদ তৈরি হচ্ছে। এটাও একটা কারণ।’

শুধু এই অবৈধ সম্পর্ক নয়, মাদককে একটা বড় কারণ হিসেবে দেখছেন অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল। তিনি বলেন, একজন মানুষ নিয়মিত মাদক গ্রহণ করলে তার মস্তিষ্কের জাজমেন্টাল সেলগুলোর এক্টিভিটি কমে যায়। ফলে যারা মাদক নিচ্ছেন তারা এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন হরহামেশাই। এটাও আমাদের দেখতে হবে।’

তবে মানুষের এই ধরনের অপরাধগুলোকে নৈতিকতার অবক্ষয় হিসেবেই দেখছেন ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, আমরা প্রায়ই এই ধরনের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে দেখি মানুষের নৈতিকতার খুব অবক্ষয় হয়েছে। আবার নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত হওয়ার কারণেও অনেক মানসিক বিপর্যয় থেকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই ধরনের অপরাধগুলো করে ফেলছে। সর্বশেষ বনানীর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, ফাতেমা খাতুন নামে যে নারীকে আমরা গ্রেফতার করেছি, ওই নারী স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত ছিলেন। ক্ষোভ, হতাশা থেকেই তিনি স্বামীকে হত্যার পর ছয় টুকরো করেন। আবার দক্ষিণখানে স্ত্রীর পরকীয়ার সম্পর্কের জেরে স্বামীকে হত্যা করেন ইমাম।

গত মার্চে গাজীপুরে স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ সাত টুকরো করেন স্বামী জুয়েল আহমেদ। গ্রেফতারের পর জুয়েল পুলিশকে বলেছে, পারিবারিক কলহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। যন্ত্রণা আর সইতে পারছিলেন না। গত বছরের অক্টোবরে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নের একটি বিল থেকে নূরজাহান বেগম (৫৫) নামে একজনের চার টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। এইসব ঘটনার রহস্য উদঘাটন হলেও অনেক ঘটনারই রহস্য আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। গত বছরের অক্টোবরেই কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার নাওতলা এলাকায় চা দোকানদার নাসির উল্লাহকে (২৮) কুপিয়ে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে লাশ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার রহস্য এখনও উদঘাটন হয়নি।

Pin It