সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ৭০ হাজার ভাতাভোগীর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এসব ভাতার মধ্যে রয়েছে বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা, প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি।
এসব সুবিধাভোগীর ডাটা নেই সংশ্লিষ্ট সমাজ কল্যাণ অফিসে। অথচ দীর্ঘদিন এসব ব্যক্তির নামে ভাতার টাকা ইস্যু হয়ে আসছে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতার অর্থ সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া (জিটুপি বা গভর্নমেন্ট টু পারসন) সম্পন্ন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
কেন ডাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না-এর কারণসহ জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক প্রতিবেদন দাখিল করতে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে (ডাইরেক্টর জেনারেল বা ডিজি) নির্দেশ দিয়েছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু যুগান্তরকে বলেন, গ্রামের মানুষ, বয়স্ক মানুষ অনেকে শিক্ষিত নন।
ভাতা উত্তোলনের সময় নিজের মোবাইল নম্বর না দিয়ে অন্যজনের নম্বর দিয়েছেন। দেখা গেছে, যার নম্বর দিয়েছেন তিনিও কোনো না কোনো ভাতার টাকা গ্রহণ করছেন। ফলে একই নম্বরে দুটি সুবিধাভোগীর নাম পাওয়ায় অনেকে বাদ পড়েছেন। হয়তো আগে বুঝতে পারেননি পৃথক সিম কার্ড দরকার হবে।
আবার অনেকে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের সিম কার্ড ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু তাদের নাম তথ্য ভাণ্ডারে নেই। এ ধরনের কিছু ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
তবে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ চলছে। তিনি আরও বলেন, ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে যে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য ছিল এখন টাকা যাচ্ছে সরাসরি সুবিধাভোগীর কাছে। ফলে তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবে একটি পদ্ধতির বড় পরিবর্তনে কিছু সমস্যা থাকবে। আগামীতে সেগুলো উত্তরণ ঘটানো হবে।
সমাজ সেবা অধিফতরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলামের সঙ্গে বুধবার ও বৃহস্পতিবার তার মোবাইল ফোন নম্বরে (অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে থেকে নেওয়া) একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে বুধবার তার ব্যক্তিগত ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানোর পর যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনে মহাপরিচালকে দপ্তরের টিএন্ডটি ল্যান্ডফোন থেকে এক ব্যক্তি যোগাযোগ করেন। ওই ব্যক্তি মহাপরিচালকের নির্দেশে কল করেছেন এবং ই-মেইলে পাঠনো প্রশ্নের উত্তর দেন মহাপরিচালকের পক্ষে। তিনি বলেন, ৩০ জুনের মধ্যে আশা করা হচ্ছে শতভাগ ভাতাভোগী প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে।
এ নিয়ে সমাজ সেবা অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে কাজ চলছে। ভাতাভোগীদের খুঁজে না পাওয়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্টদের ভোটার আইডি কার্ডের ত্রুটি, মৃত্যুবরণজনিত সমস্যা, ব্যক্তি নিরুদ্দেশ ও মাইগ্রেশনের কারণে প্রকৃত ভাতাভোগীদের ডাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, যাদের ডাটা পাওয়া যাচ্ছে না আইন অনুযায়ী আরও ৬ মাস অপেক্ষা করা হবে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সূত্রমতে, সম্প্রতি এ বিষয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে মন্ত্রী ভাতাভোগীর ডাটা খুঁজে না পাওয়ার বিষয়ে জেলা ও উপজেলাভিত্তিক বিস্তারিত বিভাজন উল্লেখ করে কারণসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ডিজিকে। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা যত দ্রুত সম্ভব জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে। আর এ পদ্ধতি ভাতা দিলে প্রকৃত উপকারভোগীর কাছে এ টাকা পৌঁছবে।
ওই বৈঠকে কর্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, ভাতাভোগীদের খুঁজে না পাওয়ার ব্যাপারে সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় আনার কার্যক্রমের শুরুতে সারা দেশে ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৩ জন ভাতাভোগীর ডাটা খুঁজে পায়নি।
পরে সরকারের ভাতা বাস্তবায়ন নীতিমালা অনুযায়ী ২ লাখ ৩৪ হাজার ৪২১ জনকে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপরও এখন ৯৯ হাজার ৯৮১ জনের ডাটা পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ তথ্যমতে ৭০ হাজার ভাতাভোগীর ডাটার সন্ধান এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ১ জুলাই থেকে শতভাগ ভাতা যাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাবে ৭০ হাজার ভাতাভোগীর ডাটা ও তাদের সন্ধান না পেলেও দীর্ঘদিন ধরে এসব উপকারভোগীর নামে অর্থ গেছে এবং সেটি উত্তোলন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি মাসে ৫শ টাকা, বিধবা ভাতা ৫শ টাকা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ৭৫০ টাকা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ৭৫০ থেকে ১৩০০ টাকা। আর গুরুত্বপূর্ণ এ চারটি কর্মসূচির মাধ্যমে চলতি অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা ভাতা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতা প্রতিজন ২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, বিধবা ভাতা ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ৯৫ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃদ্ধি দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার থেকে ব্যক্তি (জিটুপি) পদ্ধতি উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতা সুবিধাভোগীর মোবাইলে পাঠানোর পদ্ধতির সূচনা করা হয়।
জানা গেছে, চারটি খাতে ভাতাভোগীর সংখ্যা ৮৬ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪৯ লাখ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতার সংখ্যা ২০ লাখ ৫০ হাজার, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ১৮ লাখ এবং ১ লাখ হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। এদের প্রত্যেককে জিটুপি পদ্ধতিতে ভাতা মোবাইলে দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় আনতে দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘বিকাশ ও নগদ’ কর্তৃপক্ষকে।
বিকাশ ও নগদের কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ২৪ মে সর্বশেষ একটি রিপোর্ট পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। সেখানে দেখা গেছে, ৭৬ লাখ উপকারভোগীকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাব খোলার কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে নগদের অধীনে আছে ৫৭ লাখ ৯ হাজার ৮৬১ জন এবং বিকাশ করবে ১৯ লাখ ৩ হাজার ২২৭ জন উপকারভোগীর।
বিকাশের রিপোর্টে বলা হয়, এ কর্তৃপক্ষ ২৩টি জেলার সুবিধাভোগীদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলছে। নির্দিষ্ট জেলাগুলোর ১৩২টি উপজেলার মধ্যে ১৯ লাখ ৩ হাজার ২২৭ জনের হিসাব খুলেছে ১৩ লাখ ৮ হাজার ৭৮৪ জনের। বাকিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অপর সংস্থা নগদের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্ধারিত ৩৯টি জেলার মধ্যে ৩৫টি জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ উপকারভোগীর হিসাব খোলা সম্পন্ন হয়েছে। বাকিদের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারবে। কিন্তু তাদের দেওয়া তথ্য মতে, ৯৯ হাজার ৯৮১ জনের ডাটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে এর আগেও অনিয়ম হয়েছে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএসএস) মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগ্য না হয়েও ভাতা নিচ্ছেন ৪৬ শতাংশ। আর বয়স্ক ভাতায় শর্ত পূরণ করেননি ৫৯ শতাংশ। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতায় অনিয়ম ধরা পড়েছে ২৩ শতাংশ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়, সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্য ভাণ্ডারে নাম অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ২০০ টাকা ঘুষ দিতে হয় উপকারভোগীদের। অতি দরিদ্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছ থেকেও ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে সুবর্ণ কার্ডের জন্য এক থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে যে নতুন দুই লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতার আওতায় এসেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ভাতার অর্থের অংশ বিশেষ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে এসেছে গবেষণায়।