পরিবহণ ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে শুক্রবার সকাল থেকে দেশব্যাপী বাস ও ট্রাক ধর্মঘট শুরু হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে খাদ্যবোঝাই ট্রাক রাজধানীর পাইকারি আড়তে এসে পৌঁছায়। সেজন্য শুক্রবার পর্যন্ত পাইকারি পর্যায়ে কোনো পণ্যের সংকট হয়নি। এদিন পর্যন্ত পাইকারিতে পণ্যের দামও ছিল স্বাভাবিক।
তবে পাইকারি আড়ত থেকে খুচরা বিক্রেতাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পরিবহণ না পাওয়া বা বিকল্প বাহনে বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে। এতে খুচরা পর্যায়ে বেশকিছু পণ্য যেমন-আটা, ভোজ্যতেল, শুকনা মরিচ, রসুন, কিছু সবজি বাড়তি দরে বিক্রি হয়েছে। এসব পণ্য কিনতে ক্রেতার বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধর্মঘট চলমান থাকলে শুক্রবার রাতেই আর বিভিন্ন জেলা থেকে পণ্যবোঝাই ট্রাক রাজধানীতে আসবে না। এরই মধ্যে অনেক ট্রাকমালিক পণ্য আনা-নেওয়ার বায়না বাতিল করেছে। অনেকেই টাকা ফেরত দিয়েছে। এতে শনিবার (আজ) থেকেই রাজধানীর পাইকারি বাজারে ভেঙে পড়বে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। ফলে পণ্যের সরবরাহ সংকট দেখা দেবে। তাই স্বভাবতই পাইকারি বাজারের পাশাপাশি খুচরা পর্যায়ে অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে সব ধরনের পণ্যের দাম। আর এই বাড়তি দরের বোঝা সব সময়ের মতো সাধারণ ক্রেতাকেই বহন করতে হবে। বিক্রেতারা শুধু দামে সমন্বয় করবে।
রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার প্রতিকেজি শিম বিক্রি হয়েছে ১২০-১৬০ টাকা, যা ধর্মঘটের আগে ৮০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৪০-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ঢেঁড়স শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ৬০-৮০ টাকা। প্রতিকেজি পটোল বিক্রি হয়েছে ৫০-৬০ টাকা, যা আগে ৪০-৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। মানভেদে এক কেজি গাজর বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা, যা ধর্মঘটের আগে ১৪০ টাকা বিক্রি হয়েছে। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি টমেটো বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৬০ টাকা।
নয়াবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. সোহেল বলেন, ভোরে কাওরান বাজারে পাইকারি আড়তে সবজি নিতে গিয়েছি। সবজিও কিনেছি। সেখানে ধর্মঘটের কোনো প্রভাব দেখিনি। সব ধরনের সবজির ট্রাক রাতেই এসেছে। তাই দাম বাড়েনি। তবে সবজি কিনে কাওরান বাজার থেকে নয়াবাজারে আসার মতো কোনো পিকআপ পাইনি। অনেক চেষ্টার পর একটি ভ্যান যেতে রাজি হলে তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে আসতে হয়েছে। এ ছাড়া পৌঁছাতে সময় বেশি লাগায় সবজিও নষ্ট হয়েছে। সব মিলে বাড়তি টাকা ব্যয় হওয়ায় কিছু টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। যদি ধর্মঘট চলমান থাকে তবে কাল (আজ) থেকেই সব ধরনের পণ্যের দাম হু-হু করে বেড়ে যাবে।
খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, প্রতিকেজি প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হয়েছে ৩৮-৪০ টাকা। যা দুই দিন আগেও ৩৫-৩৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৭৬০ টাকা। এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা। যা ধর্মঘটের আগে বিক্রি হয়েছে ১৫৫ টাকা। প্রতিকেজি দেশি রসুন ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা। দেশি শুকনা মরিচ কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা ঊর্মি বেগম বলেন, বাজারে সব ধরনের সবজি আছে। তবে দাম গত দু-একদিনের তুলনায় বেশি। বিক্রেতারা বলছেন, ধর্মঘটের কারণে দাম বেড়েছে। পাশাপাশি একাধিক পণ্যের দাম বাড়তি।
তিনি বলেন, এমনিতেই কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের বাজারে বাড়তি দরে আমাদের নাভিশ্বাস বাড়ছে। ঠিক সে সময় সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এতে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। পরিবহণ খরচ বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের আরও ভোগান্তি হবে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, পণ্যের দাম কমানোর জন্য সরকার কোনো উদ্যোগ তো নেয়নি, বরং দাম আরও বাড়ানোর জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। এ দেশে কি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য চিন্তা করার মতো কেউ নেই?
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানি এমন একটা পণ্য যার দাম বাড়লে মূলত সবকিছুর দাম বাড়ে। এতে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। জ্বালানির দাম বাড়লেই পরিবহণের ভাড়া বাড়বে। ফলে পরিবহণে যেসব পণ্য আসবে সেগুলোর দামও বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। পাশাপাশি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে ক্রেতার কিনতে হবে বাড়তি দরে।
তিনি জানান, করোনাকালে এমনিতেই মানুষের আয় কমেছে। ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এমনিতেই বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। এর সঙ্গে জ্বালানির দাম বাড়ানো মানে ভোক্তার জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তাই এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আবারও একটু বিবেচনা করা দরকার। এছাড়া পরিবহণ ধর্মঘট চলছে। আর এই ধর্মঘট চলমান থাকলে পণ্য সংকটের শঙ্কা দেখা দেবে। ফলে পণ্যের দাম আরও বাড়বে। যার ধকল সাধারণ ক্রেতাকেই নিতে হবে।
জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, জ্বালানি তেলে দাম বাড়ার অজুহাতে যাতে অসাধুরা পণ্যের দাম না বাড়ায় এজন্য মোকাম, পাইকারি আড়ত ও খুচরা বাজার-এই তিন স্তরে নজরদারি করা হবে। কেউ অসাধু পন্থার আশ্রয় নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।