বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ পার হল পঞ্চাশের মাইলফলক; লক্ষ্য সমৃদ্ধ আগামী। শূন্য থেকে শুরু সেই অগ্রযাত্রার গল্প তুলে ধরা হল বিজয় উৎসবের সাংস্কৃতিক আয়োজনে।
দেশের গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক পুঁথিপাঠের ধারা বর্ণনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে চলে শুক্রবার সন্ধ্যার পুরো অনুষ্ঠানমালা; এর ফাঁকে চলে গান, কবিতা আর নৃত্যের পরিবেশনা।
জাতীয় সংসদে দেয়ালে আলোর প্রক্ষেপণে তুলে ধরা হয় জাতির পিতার সংগ্রামী অবয়ব আর শব্দযন্ত্রে শোনানো হয় তার বজ্রকণ্ঠ।
সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বৃহস্পতিবার থেকে দুদিনব্যাপী এই বিজয় উৎসব আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। শুক্রবার হল তার সমাপনী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠানস্থলে তাকে স্বাগত জানান। সন্ধ্যা ৬টার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
মাসুম রেজার লেখা পুঁথিপাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠান এগিয়ে নেন অভিনেতা মাসুম আজীজ; প্রতি ধাপে পুঁথিপাঠের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে পরবর্তী উপস্থাপনার বিষয়বস্তু।
পুঁথির শুরুতে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের উন্নয়ন পরিক্রমার প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার পর দলগত আবৃত্তিতে আসে সেই পথযাত্রার নানা দিক।
সোহেল আনোয়ারের গ্রন্থনা ও হাসান আরিফের নির্দেশনায় ’মহাবিজয়ের মহানায়ক’ শিরোনামের এই পরিবেশনার সংগীতায়োজনে ছিলেন দেবজ্যোতি মিশ্র।
চল্লিশ জন বাচিকশিল্পীর এই দলের পরিবেশনায় নেতৃত্ব দেন অভিনেতা-আবৃত্তিকার আসাদুজ্জামান নূর। তাদের আবৃত্তির সঙ্গে চলে নৃত্য।
‘আমি জন্মেছি বাংলায়’, ‘আমি জন্মেছি বাংলায়’, ’জয় বাংলা, জয় বাংলার জয়’ ইত্যাদি কবিতা শোনান তারা।
আবৃত্তির পর পরিবেশন করা হয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর থিম সংগীত ’একটাই আছে দেশ’, জুলফিকার রাসেলের লেখা এই গানের সুরারোপ করেছেন সাজিদ সরকার।
থিম সংগীতের সাথে ছিল নাচের দল নৃত্যাঞ্চলের শতাধিক শিল্পীর পরিবেশনা; নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ ও শামীম আর নীপা ছিলেন অগ্রভাগে।
এরপর আবার পুঁথিগান নিয়ে মঞ্চে আসেন মাসুম আজীজ, তুলে ধরেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা।
পুঁথির বর্ণনায় ’কান পেতে শুনি’ শীর্ষক পরিবেশনার জন্য শিকড় সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আহ্বান করেন উপস্থাপক।
দোতরা, বেহালা, বাংলা ঢোলের বাদ্যে আর গানের মূর্ছনায় বাংলার প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশকে তুলে ধরেন শিকড়ের শিল্পীরা। ফুটিয়ে তোলা হয় গ্রামীণ সংস্কৃতি আর ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য।
পুঁথিপাঠের মাধ্যমে সারা বিশ্বের শোষিত জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি পিতার পথ ধরে তার কন্যা শেখ হাসিনার পথচলার গল্পও বলেন মাসুম আজীজ।
এরপর সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবেশনার জন্য সাধনা শিল্পী গোষ্ঠীকে মঞ্চে আহ্বান করেন তিনি।
’সাধনার’ শিল্পীদের মরমী, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, ধামাইল, গম্ভীরার পরিবেশনার সাথে ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবেশনা।
আঞ্চলিক সংস্কৃতির উপস্থাপনার পর পুঁথিপাঠে তুলে ধরা হয় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশের পথচলার গল্প। বলা হয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই নীতির স্বীকৃতির কথাও।
এরপর দেশীয় শিল্পীদের সাথে সংগীত পরিবেশনায় আসেন বিদেশি শিল্পীরা। অন্যান্য বাংলা-ইংরেজি গানের পাশাপাশি জোয়ান বায়েজের ঐতিহাসিক ‘বাংলাদেশ’ গানটিও তারা পরিবেশন করেন।
বাংলাদেশের রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা আর অর্ণবদের সাথে স্কটল্যান্ডের সারা জয়েস, সেনেগালের কাদিয়ালি কোইয়াটে আর তুরস্কের ক্যানারকানের মত শিল্পীরা ছিলেন সেখানে।
পুঁথির ধারা বর্ণনায় বর্তমান উন্নয়নযাত্রা তুলে ধরার গান-নৃত্যেও ছিল উপস্থাপনায়। শিল্পীরা তুলে ধরেন পদ্মাসেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল আর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মত প্রকল্পকে। ইমন চৌধুরীর রচনায় এই অংশ পরিচালনা করেন তারিক আনাম খান।
এরপর পুঁথিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া এবং বিশ্ব শান্তির জন্য বাংলাদেশের কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন মাসুম আজীজ।
মানবিক কাজের বিবরণ তুলে ধরার পর মঞ্চে আসে আগামীর প্রজন্মের প্রতিনিধি শিশুশিল্পীরা।
এ পর্বের গান আর নৃত্যে আটটি বিভাগ থেকে বাছাই করা ৮৫ জন শিশু শিল্পীর সঙ্গে ছিলেন শিল্পী রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা ও সৈয়দ আব্দুল হাদী।
ইববার টিপুর সংগীতায়োজনে এ পর্বে ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’, ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’, ‘জয় হোক, জয় হোক, শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক, সত্যের জয় হোক’, ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’, গানগুলো শোনানো হয়।
শিশুদের জন্য সম্ভাবনাময় ও সুন্দর পৃথিবীর আশায় সৈয়দ আব্দুল হাদী গেয়ে শোনান, ’আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে/আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’।
মঞ্চে আলোর খেলায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং দেশের অগ্রযাত্রা তুলে ধরার মাধ্যমে শেষ হয় বিজয় উৎসব।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক স্মরণ করেন, গত পঞ্চাশ বছর ধরে ঝরঝঞ্ঝা পেরিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার মন্ত্র এখনও বঙ্গবন্ধুর চেতনা।
“যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন ’মহাবিজয়ের মহানায়ক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আজ অকুণ্ঠ আঁখি মেলে জেগে উঠছে তার সোনার বাংলা।
”আর এই সোনার বাংলাতেই জেগে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, জেগে ওঠেন কালের ঊর্ধ্বে, সকল কালে, সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে মহাবিজয়ের মহানায়ক হয়ে।”