সারা দিনের ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর যেন আর চলতে চায় না। একটা বিছানা পেলেই বর্তে যায়। নিশ্চিন্তে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাতে পারি। এটা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের চলমান ধারা। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। এমনই হয়তো চলতে থাকবে। আমরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি; নিশ্চিন্তে পথ চলতে পারি, কাজ করতে পারি; কিন্তু এর পেছনে যাদের অবদান, তাদের কথা বেমালুম ভুলে যাই।
পুলিশ! স্যালুট এই পুলিশ সদস্যদের। হ্যাঁ, পুলিশ জেগে থাকে বলেই আমরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। পারি কাজ করতে। কারণ বিতর্ক যতই থাকুক, আমরা সবাই জানি- তারা আমাদের নিরাপত্তা দেবে। ডাকলে আসবে। তারা দিনে-রাতে পাহারা দেয় বলেই খারাপ লোকেরা ভয়ে থাকে। শীত-গ্রীষ্ম, রোদ-ঝড় মাথায় নিয়ে তারা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে।
পুলিশে খারাপ লোক নেই এ কথা বলছি না। সবখানেই আছে। পরিবারের মধ্যেও থাকে। তাই বলে দুই-একজন খারাপের জন্য পুরো প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করতে পারি না। যত খারাপই থাকুক, কোনো অঘটন, দুর্ঘটনা, খুন, রাহাজানি হলে আমরা প্রথম যাদের কাছে পাই- তারা পুলিশ। তাছাড়া কোনো কিছু হলে আমাদের পুলিশের কথাই প্রথম মনে পড়ে। আর এটা সমসাময়িক নয়; অনেক আগে থেকেই। প্রাচীনকাল থেকে পুলিশ ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন নামে আমাদের নিরাপত্তা দিতে আমাদের পাশেই ছিল।
আমরা সামাজিক জীবনে অনেক কিছুই করি। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর অনেকেই আছেন- যারা তাদের পরিবার, সন্তানদের সময়ই দিতে পারেন না। কোনো অনুষ্ঠানে যখন আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে আত্মহারা- তখন পুলিশের সদস্যদের দেখেছি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের নিরাপত্তা দিতে। ঈদের সময় দেখেছি- মুসল্লিরা যখন নামাজ আদায় করে কোলাকুলি করেন, তখন পুলিশ সদস্যরা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকেন- নিরাপত্তা দিতে ‘ভয় নেই আমরা আছি’ এমন ভাব করেন। অথচ আমরা কখনো তাদের দিকে ফিরেও তাকাই না। তারা তাদের শখ-আহ্লাদ, জীবনের মায়া ত্যাগ করে আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ করছেন। কখনো তাদের মনের ভিতরের কামনা-বাসনা অনুভব করার চেষ্টাও করিনি।
অনেকে বলবেন- পুলিশ তাদের কর্তব্য পালন করছে, বিনিময়ে তারা বেতন নিচ্ছে; কিন্তু আমরা কি পারব। আমরাও চাকরি করি। আমাদের কর্তৃপক্ষ যদি ঈদ-পূজা বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে কাজ করতে বলেন- তখন আমরা কী পারব? প্রশ্নটা সবার জন্যই।
যারা পুলিশে চাকরি করেন তারাও মানুষ, তাদের জীবন আছে, তাদেরও প্রয়োজন আছে আনন্দ বিনোদনের, স্ত্রী-সন্তান,বাবা-মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার। অথচ আমরা বেমালুম তা ভুলে যাই। ভুলে যাই তাদের ত্যাগের কথা। তাদের কোনো ভুল ধরা পড়লে আমরা হামলে পড়ি। তাদের বিচার দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলি।
পুলিশের সবাই ভালো, তারা ভুল করে না, অনৈতিক কাজ করে না- তা বলছি না। একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে গুটিকয়েক লোক খারাপ লোক অবশ্যই আছে। নীতির মধ্যে থেকেও অনেকে অনৈতিক কাজ করে। তাদের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। আর ভালো কাজের প্রশংসা অবশ্যই আমাদের করা উচিত।
পুলিশের ইতিহাস অনেক পুরনো। ভিন্ন নামে ও ভিন্ন ধরনে পুলিশ ছিল পুরাতন সভ্যতা হিসেবে। রোম শহরে অগাস্টাস সময়েও পুলিশের অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা করেন ইতিহাসবেত্তারা। মনুসংহিতা, সম্রাট অশোকের সময়কার চিত্রলিপি ও প্রখ্যাত ভ্রমণকারীদের ইতিহাস রচনার মধ্যে পুলিশের খণ্ডিত ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাচীন কালে কোতোয়াল, সিপাই, গুপ্তচর, দ্বাররক্ষক ইত্যাদির যে অস্তিত্ব মেলে, তা এই যুগের পুলিশের কাজের মতোই।
অগস্টাসের রোমান সাম্রাজ্যে পুলিশের অস্তিত্ব দেখা যায়। সেখানে ‘ভিজিল’ নামের পুলিশ বাহিনী ছিল। মধ্যযুগে স্পেনের সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনীকে বলা হতো ‘হলি ব্রাদারহুডস’।
এরপর মধ্যযুগীয় সময়েও এই উপমহাদেশে পুলিশি কার্যক্রমের উদহারণ পাওয়া যায়। সেই সময়েও শহর অঞ্চলে পুলিশ কর্মকর্তার আদলে ছিল কোতোয়াল; আর পুলিশ সদস্যদের মতো কাজ করতো সিপাহী; যা বিভিন্ন ইতিহাসে পাওয়া যায়। এ ব্যবস্থা শহরের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে খুব কার্যকর হিসেবে পরিগণিত হয়। কোতোয়ালি পুলিশ ব্যবস্থা সব শহরের মধ্যে ছিল বলে ধারণা করা হয়। কারণ অনেক জেলা সদর পুলিশ স্টেশনকে এখনো বলা হয় কোতোয়ালি থানা; যা মুঘল আমলে কোতোয়াল থেকে এসেছে।
১৭৮৯-১৭৯৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের রাজা হেনরি দেশের শাসন কায়েম রাখার জন্য সরকারের অনুগত কয়েকটি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই বর্তমান পুলিশ বাহিনী সৃষ্টির একটি ধারণা চলে আসে। এর পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ বাহিনীর সৃষ্টি হয়। উদ্দেশ্য জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া। বিংশ শতাব্দীতে এসে পুলিশ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
শিল্প বিপ্লবের কারণে ইংল্যান্ডের সামাজিক ব্যবস্থায় অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে স্যার রবার্ট পিল ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে পুলিশ গঠনের বিল আনেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় লন্ডন মেট্রো পুলিশ। অপরাধ দমনে বা প্রতিরোধে এর সাফল্য শুধু ইউরোপ নয় সাড়া ফেলে আমেরিকায়ও। ১৮৩৩ সালে লন্ডন মেট্রো পুলিশের অনুকরণে গঠিত হয় নিউইয়র্ক সিটি নগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়।
১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। পরে লন্ডন পুলিশের সাফল্যে ভারতে স্বতন্ত্র পুলিশ ফোর্স গঠন করা হয়। ১৮৬১ সালে the commission of the Police Act (Act V of 1861) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয়। এই আইনের অধীনে ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। প্রদেশ পুলিশপ্রধান হিসেবে একজন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং জেলা পুলিশ প্রধান হিসাবে সুপারিটেনটেন্ড অব পুলিশ পদ সৃষ্টি করা হয়। ব্রিটিশদের তৈরি এই ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশ পুলিশে প্রবর্তিত আছে।
এদিকে বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় হলো ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, বেশ কয়েকজন এসপিসহ প্রায় সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্য বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে জীবনদান করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস হতেই প্রদেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব হারিয়েছিল পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার। পুলিশের বীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এরপর ২৫ মার্চ তারা ঢাকার রাজারবাগের পুলিশ লাইন্সে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। পুলিশ সদস্যরা দীর্ঘ ৯ মাস দেশব্যাপী গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১ হাজার ২৬২ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের তালিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। ঝিনাইদহের তৎকালীন সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে ঐতিহাসিক গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। গত এক দশকে জঙ্গিবাদ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির কারণে একসময়ে অভিযুক্ত ছিল এই বাহিনী। এখন পেশাদারিত্ব আর দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে এখন জনগণের গর্বের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে পুলিশ।