বুস্টারেও কমছে না করোনার দাপট

image-510545-1642535830

দেশে চলছে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের দাপট। এর প্রভাবে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে করোনা। অনেকটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সংক্রমণ। দেশের ৬৩ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে ১১ দফা বিধিনিষেধ। শুরু হয়েছে বুস্টার ডোজ প্রয়োগও। তবে যারা বুস্টার ডোজ নিচ্ছেন তাদের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন করোনায়। কোনোকিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সংক্রমণের গতি। শনাক্ত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালেও বাড়ছে রোগী।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনা সংক্রমণের চিত্রে দেখা যায়, প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত। নতুন বছরের শুরুর দিন শনাক্ত হয়েছিল মাত্র ৩৭০ জন। মঙ্গলবার তা বেড়ে হয়েছে ৮৪০৭। এদিন শনাক্তের হার বেড়ে হয়েছে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আগের দিন শনাক্ত হয়েছিল ৬৬৭৬ জন। একদিনে সংক্রমণ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। শুধু সংক্রমণ নয় বাড়ছে মৃত্যুও। বছরের শুরুর দিন করোনায় মারা যান চারজন। বুধবার মারা গেছেন ১০ জন। শুধু সংক্রমণ আর মৃত্যু নয় বাড়ছে শনাক্তের হারও। ১ জানুয়ারি শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সর্বশেষ মঙ্গলবার তা বেড়ে হয়েছে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১৭ দিনে শনাক্তের হার বেড়েছে ২১ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা পরিস্থিতি চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১২ জানুয়ারি শনাক্ত হয়েছিল ২৯১৬, শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৬৮। পরদিন শনাক্ত হয় ৩৩৫৯, হার ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৩। ১৪ জানুয়ারি ৪৩৭৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। ওইদিন সংক্রমণের হার ছিল ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ১৫ জানুয়ারি শনাক্ত কিছুটা কম ছিল। কারণ আগেরদিন শুক্রবার হওয়ায় নমুনা পরীক্ষা কম হয়। ওইদিন শনাক্ত হয় ৩৪৪৭ জন এবং সংক্রমণের হার ছিল ১৪ দশমিক ৩৫। পরেরদিন এক লাফে শনাক্ত প্রায় দুহাজার বেড়ে যায়। ১৬ জানুয়ারি ৫২২২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশে। সোমবার শনাক্তের হার আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

বছরের শুরুর দিন রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় মোট রোগী ভর্তি ছিল ৩৬২ জন। সর্বশেষ মঙ্গলবার এসব হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৭৬।

এদিকে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোভিড-১৯-এর জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিএসএমএমইউ’র ভিসি এবং জিনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্টের প্রধান সুপারভাইজার অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এ উপলক্ষ্যে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, গত ৮ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ৮ জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত সংগৃহীত স্যাম্পলের ২০ শতাংশই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ও ৮০ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়। পরবর্তী মাসে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট গুণিতক হারে বৃদ্ধির আশঙ্কা করা যাচ্ছে।

যদিও যখন এ গবেষণার জন্য স্যাম্পল নেওয়া হয় তখন দেশে নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ ছিল খুবই কম। সর্বশেষ তথ্য নিয়ে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হলে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী বাড়বে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও এমনটাই বলেছেন। সোমবার সচিবালয়ে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় করোনা শনাক্তে যে নমুনা আমরা পরীক্ষা করেছি, তার জিনোম সিকোয়েন্স করেছি, তাতে দেখা গেছে ওমিক্রন (আক্রান্তের) এখন ৬৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যেটা আগে ১৩ শতাংশ ছিল। আমরা গত ১০ দিনের মধ্যেই এই তথ্য পেয়েছি। আমরা মনে করি ঢাকার বাইরেও একই হার হবে।’

বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরও ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করেন, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এই টিকার এটাই প্রকৃতি। বুস্টার দিলে করোনা থেকে শতভাগ সুরক্ষা মিলবে এমন নয়। তবে বুস্টার ডোজে করোনা আক্রান্ত হলেও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না। মৃত্যুর হারও অনেক কম। তাই দেরি না করে টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ৬০ বছরের বেশি বয়সি জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। বুস্টার ডোজের বয়সসীমা ৬০ বছর থেকে কমিয়ে ৫০ করা হয়েছে। দুটি ডোজ শেষ হওয়ার পর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে আরও তিন সপ্তাহ সময় লাগে। তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজের ক্ষেত্রেও তা একই রকম। সে পর্যন্ত সতর্ক না থাকলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

এ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউর ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রন অনেক বেশি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। ওমিক্রনের জেনেটিক কোডে ডেল্টার চেয়ে বেশি ডিলিশন মিউটেশন পাওয়া গেছে। যার বেশিরভাগেই ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন রয়েছে। এই স্পাইক প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে টিকা তৈরি হয়। স্পাইক প্রোটিনের বদলের জন্য প্রচলিত টিকা নেওয়ার পরেও ওমিক্রন সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়।

বুস্টার ডোজ নিয়ে মানুষ আবার কেন করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, এমন প্রশ্ন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমানকে। তিনি  বলেন, বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরেও কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হতে পারেন, এটা স্বাভাবিক।

এর প্রথম কারণ করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন টিকাকে ফাঁকি দিতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাকে ভ্যাক্সো ইনফেকশন বা আন প্রোটেকটেড (টিকা নেওয়ার পরও অরক্ষিত) বলে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, দুনিয়াজুড়েই হচ্ছে। এ কারণে কোনো কোনো দেশে টিকার চতুর্থ ডোজ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

আরেকটি বিষয় ভাইরাসটির যে স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করে করোনা টিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই স্ট্রাকচারের (স্পাইক প্রোটিন) ৩০টির বেশি মিউটেশন (করোনাভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন) হয়েছে। ফলে টিকা নেওয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ অনেক সময় সেটাকে যথাযথভাবে শনাক্ত করতে পারছে না। বিশেষ করে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে এটি বেশি হতে পারে। ফলে এই ডোজ কতখানি নিরাপত্তা দিতে পারবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা কঠিন হচ্ছে। তাই এটিকে টিকার বুস্টার না বলে তৃতীয় ডোজ বলা উচিত।

সায়েদুর রহমান আরও বলেন, করোনা প্রতিরোধে টিকা নেওয়ার পাশাপাশি শরীরে যেন ভাইরাস প্রবেশ না করতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যেমন-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক নিয়মে তিনস্তরবিশিষ্ট মাস্ক পরা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা। সাবান পানি দিয়ে উত্তমরূপে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ‘দেশে টিকা দেওয়ার আগে ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত আছেন কি না, সেটা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। ফলে অনেক আক্রান্ত ব্যক্তিকেও টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকা নিতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে তিনি অনেককে আক্রান্ত করছেন। আবার যারা টিকা নিচ্ছেন, তারা অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। যে কারণে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগেই তারা আক্রান্ত হচ্ছেন।’

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, করোনা প্রতিরোধে দেশে টিকাদান কর্মসূচি চলমান রয়েছে। তবে কেউ টিকা নিলেই যে করোনা আক্রান্ত হবেন না, এমন নয়। করোনার টিকা নিলেও মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। ভাইরাসটি প্রতিরোধে টিকা একটি বড় হাতিয়ার। এ ছাড়া টিকা নেওয়ার পরে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের জটিল পরিস্থিতি কম তৈরি হচ্ছে। টিকা নেওয়া ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা অনেক কম। টিকা নেওয়া ব্যক্তির করোনা আক্রান্তের হার ১০ শতাংশ এবং মৃত্যু হার ১ শতাংশ।

তিনি বলেন, গবেষণাটি গত বছরের ২৯ জুন থেকে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশের করোনা রোগীদের ওপর পরিচালিত হয়। দেশের সব বিভাগের রিপ্রেজেন্টটিভ নিয়ে স্যাম্পলিং করা হয়েছে। গবেষণায় নয় মাসের শিশু থেকে ৯০ বছর বয়সি বৃদ্ধ-সব ধরনের রোগীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২১ থেকে ৫৮ বছর বয়সের রোগীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এতে মোট ৭৬৯ কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর ন্যাযোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব স্যাম্পল থেকে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়।

২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ৮৪০৭, মৃত্যু ১০ : এদিকে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে একদিনে নতুন করে আরও ৮ হাজার ৪০৭ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৪ জন। ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৮ হাজার ১৬৪ জনের। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৪৭৫ জন।

এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৫৩ হাজার ৭৯৫ জন। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮৫৫টি ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ৩৫ হাজার ৯১৬টি। নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৫৪টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এক কোটি ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৯টি। এতে আরও জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৫ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭২ শতাংশ।

Pin It