গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আজিজুল হক ২২ বছর আত্মগোপনে ছিলেন ঢাকাতেই; করেছেন বিয়ে, করছিলেন ব্যবসা।
দীর্ঘ এই সময় খোদ রাজধানীতে থাকার পরও তাকে ধরতে না পারা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ব্যর্থতা নয় বলে দাবি পুলিশের।
সিটিটিসির প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, নিজেকে আড়াল করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন আর দীর্ঘ ২২ বছর পলাতক থাকাকালে কখনও দর্জি, কখনও মুদি দোকানি, কখনওবা বই বিক্রেতা আর নয়তবা চালক পেশায় যুক্ত ছিলেন আজিজুল।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, “দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে শুরুতে চার মাস শুধু নেত্রকোণায় ছিলেন। তারপর থেকে ঢাকার খিলক্ষেত, পুরান ঢাকার বাংলাবাজার, কেরানীগঞ্জ আর মাঝের কিছুদিন টঙ্গীতে ছিলেন।
তবে ২০০৮ সাল থেকে রাজধানীর খিলক্ষেত নিজে বাইন্ডিং ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক এ আসামি।
খিলক্ষেতের টাঙ্গাইল প্লাজায় যে দোকান খুলে বাইন্ডিং ও রাবার স্ট্যাম্প ব্যব্সা চালিয়ে আসছিল, সেখানে দোকানের নাম ছিল ‘রুমান অ্যাড’।
গত ১৪ বছর প্রতিদিন খিলক্ষেত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রূপগঞ্জের বাসায় যাতায়াত করতো ৪৪ বছর বয়সী আজিজুল।
নিজে নাম বদলে ফেললেও স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র থেকেই আজিজুল ধরা পড়েন বলে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
আজিজুলকে ধরতে জমির বায়না
সিটিটিসির প্রধান বলেন, ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিলেন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) সদস্য আজিজুল।
ঘটনার পর থেকেই ঢাকায় চলে আসেন গাজীপুরের শ্রীপুরের টানভিটার এসএম রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে আজিজুল হক।
২০০৭ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিয়ে করেন জানিয়ে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আজিজুলের পরিচয় নিশ্চিত হতে রূপগঞ্জে কয়েকবার যেতে হয়েছে এবং ছদ্মবেশ ধারণ করে ওই এলাকায় জমি কেনার গ্রাহক হয়ে বায়নাও করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “আজিজুলের তিন সন্তান রয়েছে। প্রতিদিন খিলক্ষেত থেকে রূপগঞ্জের ইছাপুরা যাতায়াত করতেন তিনি।”
যেভাবে পাওয়া গেল খোঁজ
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সিটিটিসি জঙ্গিদের নিয়ে কাজ করছে এবং গ্রেপ্তার চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গত বছরের ২৩ মার্চ যখন রায় হল এবং ৫ জন পলাতক রয়েছে; এই পাঁচজনকে নিয়ে কাজ করতেই ধরা পড়ল আজিজুল।”
তিনি বলেন, কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রথমে স্বজনদের খোঁজ নিয়ে এরপর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আজিজুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজিজুলের স্ত্রীর নামে মোবাইল সিম থাকলেও তা ব্যবহার করত না; গত এক বছরে মাত্র আট সেকেন্ড কথা বলার রেকর্ড পাওয়া যায়। আর আজিজুলের নামে কোনো সিমই পাওয়া যায়নি।
২০০১ সালের ৮ নভেম্বর নিজের ছবি দিয়ে আজিজুল মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্স করলেও সেখানে নাম দেন মো. আবু রোমান সুরুজ। আর গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর হলেও সেখানে ঠিকানা দিয়েছেন নেত্রকোণার কমলাকান্দার শিদলী।
২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করলেও নিজের নাম ব্যবহার করেছেন আজিজুল হক রানা আর বাবার নাম ঠিক থাকলেও গ্রামের বাড়ি টানভিটার স্থলে ভিটাপাড়া দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, “আজিজুলের স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্রে স্বামীর নাম আজিজুল দেখে তার স্ত্রীর মাধ্যমেই আগাতে শুরু করে পুলিশ এবং…।”
সিটিটিসি জানায়, আজিজুল হক ১৯৮৭ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে জামিয়া আনোয়ারিয়া মাদ্রাসায় নূরানী বিভাগে ভর্তি হন। পরে ওই মাদ্রাসার ওস্তাদ ও হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় সদস্য মুফতি হান্নানের অনুসারী মাওলানা আমিরুল ইসলালের মাধ্যমে হুজিতে যোগ দেয়।
ওই মাদ্রাসায় মুফতি হান্নান, আব্দুর রউফ, আব্দুস সালামসহ হুজির সদস্যদের গোপন বৈঠক হত। আজিজুল হক সংগঠনে যোগদানের পর অন্য ছাত্রসহ প্রশিক্ষণ ও তালিম নেওয়ার জন্য হরকারতুল জিহাদ নেতা মুফতি ইজহারের চট্টগ্রামের লালখান মাদ্রাসায় যায় এবং তালিম গ্রহণ করে। তালিম শেষে সেখানে বোমা তৈরি, আত্মরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
এভাবেই আজিজুল মুফতি হান্নানের সান্নিধ্য পায়।
হুজিতে যোগ দেওয়ার পর আজিজুল হক নাম পরিবর্তন করে ‘শাহনেওয়াজ’ দেয়।
সিটিটিসির প্রধান বলেন, মুফতি হান্নানের সঙ্গে বোমা পুঁতে রাখার দায়িত্বে ছিল এই আজিজুল হক রানাও।
তিনি বলেন, “কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৪ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। তাদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক ছিল। এখন লোকমান, ইউসুফ, এনামুল ও মোসাহেব নামে চারজন পলাতক রয়েছে।”
২০০০ সালে কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের জন্য মঞ্চ নির্মাণের সময় মাটিতে পুঁতে রাখা ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পাওয়া যায়। পরদিন ৪০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা উদ্ধার করা হয় কোটালীপাড়ার হেলিপ্যাড থেকে।
ওই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, হত্যার ষড়যন্ত্র এবং বিস্ফোরক আইনে কোটালীপাড়া থানায় তিনটি মামলা করে পুলিশ।
আজিজুল একটি মামলায় ২০ বছরের সাজা, রাষ্ট্রদোহ মামলায় মৃত্যুদণ্ড ও আরেকটি মামলায় খালাস পেয়েছিলেন।
২২ বছর পলাতক থাকতে পারা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ব্যর্থতা কি না জানাতে চাইলে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনের সিটিটিসির প্রধান বলেন, এটা ব্যর্থতা কেন হবে? পলাতক তো আর থাকতে পারলো না, গ্রেপ্তার হতেই হলো।
বাকি চারজনকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। আর আজিজুলকে গ্রেপ্তারের পর আরও তথ্য পেতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের মাধ্যমে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।