বঙ্গবন্ধুর মুখে ২৫ মার্চের গ্রেফতার ও পরবর্তী কাহিনি

image-534169-1648158943

[১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ট্যাংক-কামান আর বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আক্রমণের শুরুতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডি ৩২নং সড়কের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন একাধিকবার। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়া এবং তার স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অপপ্রচার চালায়। তারা বলে, জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসার পর ১৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বিদেশি সাংবাদিকদের এক সাক্ষাৎকার দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত সাংবাদিক সিডনি এইচ শ্যানবার্গ। বঙ্গবন্ধুর এ সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তার একটি বিশেষ প্রতিবেদন নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি। শ্যানবার্গের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন]

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাত। চোখের জলে ভাসতে থাকা স্ত্রী ও সন্তানদের ললাটে একে একে চুম্বন করলেন তিনি। তারপর নিলেন বিদায়। ধরে নেওয়া হয়েছিল এটিই তার শেষ বিদায়। স্ত্রী, পুত্র-কন্যারাও আশা করেনি তিনি তাদের মাঝে আর কোনোদিন ফিরে আসবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেছনে গুঁতোতে গুঁতোতে শেখ মুজিবকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে জিপের কাছে নিয়ে আসে। গ্রেফতারকে পরোয়া করেন না মুজিব।

আচরণে সে রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তিনি ফৌজিদের বললেন, তিনি পাইপ এবং তামাক ফেলে এসেছেন। সেগুলো আনতে আবার ওপরে যেতে হবে। সৈন্যরা চারদিক ঘিরে পাহারা দিয়ে তাকে আবার ওপরে নিয়ে যায়।

বেগম মুজিব তার হাতে পাইপ ও তামাকের পাউচটি তুলে দেন। বাঙালির স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবকে নিক্ষেপ করে কারাগারে।

পাকিস্তানের কারাগারে সাড়ে নয় মাস বন্দি জীবন কাঠিয়ে ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর একদল বিদেশি সাংবাদিককে শেখ মুজিব নিজেই ২৫ মার্চ কালরাতে তার গ্র্রেপ্তার, কারাজীবন এবং মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার ঘটনাবলির বর্ণনা দেন।

শ্যানবার্গের ভাষায়-‘মুক্তিলাভের কারণে অনেকটা নিরুদ্বেগ দেখালেও অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার রেশ তখনো তার মন থেকে কাটেনি। কিন্তু ভাগ্যের সুপ্রসন্নতায় বিশ্ব মানচিত্রে নতুন এক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাকে খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। ১০ মাস আগে তাকে আটককারী ইয়াহিয়া খানের ঢাকার সরকারি বাসভবনের পালঙ্কে হেলান দিয়ে কয়েকটি মার্কিন পত্রিকার সাংবাদিকের সঙ্গে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছিলেন বঙ্গবন্ধু।’

২৫ মার্চ কালরাতের ঘটনা দিয়েই মুজিব তার কথা শুরু করেন। সেই পাইপ এবং তামাকের পাউচটি ছিল তার সামনে একটি কফি টেবিলের ওপর। মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, কেন সেদিন রাতে তিনি নিজের বাড়িতে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

শেখ মুজিব বলেন, তিনি জানতে পেরেছিলেন সেদিন ঘর থেকে বের হলে গাড়িতে গ্রেনেড মেরে তাকে হত্যা করা হবে এবং সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে এ হত্যার দায় উগ্রপন্থি বাঙালিদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। এটি ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নীলনকশা। এ ঘটনাকে জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার অজুহাত হিসাবেও দাঁড় করানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। এ ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর মুজিব নিজের বাড়িতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন, যাতে পাকিস্তানিরা চাইলে তাকে নিজের বাড়িতেই হত্যা করবে।

পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা অত্যাসন্ন-এ ধরনের খবর ২৫ মার্চ সর্বত্র চাউর হচ্ছিল। তাই মুজিব তার বড় ছেলে কামাল এবং দুই মেয়েকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি স্ত্রী ও ছোট ছেলে রাসেলকে নিয়ে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। কারণ, তাকে একা রেখে অন্য কোথাও যেতে রাজি হননি বেগম মুজিব। মেজো ছেলে জামাল তখন বাড়িতেই ছিল। নিজের কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল।

রাত ১০টার দিকে মুজিব খবর পান পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে। কিছু সময় পর পাকিস্তানি সৈন্যরা তার বাড়ি ঘেরাও করে এবং কাছেই একটি মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এ আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই শেখ মুজিব গোপনে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। রাত প্রায় ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে তিনি চট্টগ্রামে এক গোপন স্থানে ফোন করে তার সর্বশেষ বার্তাটি প্রেরণ করেন। মুজিবের এ বার্তাটি রেকর্ড করা হয় এবং পরে গোপন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়।

এ বার্তায় শেখ মুজিব তার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন, জনগণকে সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতি স্বাধীনতার ডাক দেন। পরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং আধাসামরিক বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান রাইফেলসের কাছেও তিনি এ বার্তা প্রেরণ করেন।

রাত ১১টার দিকে সারা ঢাকা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মির আক্রমণ শুরু হয় এবং তা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য রাতের দিকে সৈন্যরা শেখ মুজিবের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুজিব তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান জামাল ও রাসেলকে ড্রেসিং রুমের সিঁড়িতে নিয়ে যান এবং গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেঝে মাথা নিচু করে থাকেন।

পাকিস্তানি সৈন্যরা দ্রুত গেট ভেঙে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং বাড়ির একজন প্রহরীকে হত্যা করে। তারপর তারা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে। শেখ মুজিব জানান, তিনি নিজেই সৈন্যদের ঘরের দরজা খুলে দেন এবং সৈন্যদের গুলি বন্ধ করতে বলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কেন গুলি করছ। যদি তোমরা গুলি করতে চাও, আমাকে কর। আমি তো এখানে আছি। তোমরা কেন আমার জনগণকে এবং শিশুদের ওপর গুলি করছ?

মুজিবের কথা শুনে মেজর গুলি বর্ষণকারীকে থামান। মেজর বঙ্গবন্ধুকে জানান তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখন মুজিব প্রস্তুত হওয়ার জন্য মেজরের কাছে কিছুক্ষণ সময় চান।

‘মুজিব একে একে সবাইকে চুমু খান এবং বলেন, তারা আমাকে হত্যা করতে পারে। আর কোনো দিন তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা নাও হতে পারে। কিন্তু আমার জনগণ একদিন স্বাধীন হবে। আমার আত্মা সেটি দেখবে এবং খুশি হবে।’

তারপর তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নেন। ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে মুজিবকে প্রথমে ন্যাশনাল এসেম্বলি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়। এরপর তাকে চা খেতে বলা হয়। তখন মুজিবের মনে হয়েছে তার সঙ্গে ঠাট্টা করা হচ্ছে। তাই বললেন, ‘চমৎকার, আমার জীবনে চা খাওয়ার এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ সময়।’

একটু পর মুজিবকে একটি স্কুলের অন্ধকার ও নোংরা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ছয় দিন তাকে এ কক্ষে রাখা হয়। তবে মধ্যরাত থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত তাকে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনেস্ট্রেটর এবং ৭১-এ বাঙালির ওপর পরিচালিত নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা লে. জে. টিক্কা খানের বাসভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখা হতো।

১ এপ্রিল মুজিবকে আকাশপথে নেওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানে নেওয়ার পর তাকে পাঠানো হয় মিয়ানওয়ালি কারাগারে এবং রাখা হয় ফাঁসির কয়েদিদের জন্য নির্ধারিত একটি কনডেম সেলে। পরবর্তী ৯ মাসে বিভিন্ন সময় মুজিবকে মিয়ানওয়ালি জেল এবং পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশের লয়ালপুর ও শাহিওয়াল জেলে রাখা হয়।

সামরিক সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাসহ ১২টি অভিযোগে মুজিবের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে। এসব অভিযোগের ছয়টির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আইনের ছাত্র মুজিব জানতেন এসব মামলা থেকে খালাস পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি মামলার কার্যক্রম যতদিন বিলম্ব করা যায় শুধু সেই চেষ্টাই করতে থাকেন। মুজিবের ভাষায়-‘আমিও তাদের সাথে খেলতে শুরু করি। আমি আসলে সময়ক্ষেপণ করতে চেয়েছিলাম।’

শেখ মুজিব তার পক্ষে পাকিস্তানের সবচেয়ে নামকরা আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে তার আইনজীবী হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান। মি. ব্রোহি শুধু একজন ভালো আইনজীবীই ছিলেন না, তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যও ছিলেন। সরকার শেষ পর্যন্ত মি. ব্রোহিকেই তার আইনজীবী হিসাবে নিয়োগ দেয়।

নিয়োগ পাওয়ার পর মি. ব্রোহি কোর্টে মুজিবের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থকেন। কয়েক মাস পর লয়ালপুরে সামরিক আদালতে বিচার কাজ শুরু হয়। তখন মুজিব হঠাৎ জানিয়ে দেন তিনি তার পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেবেন না, মি. ব্রোহিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর এ কথা শুনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক মার্শাল ল আইন জারি করেন। এতে বলা হয়, শেখ মুজিব রাজি থাকুন বা নাই থাকুন তার পক্ষে একজন আইনজীবী আদালতে থাকবে।

শেখ মুজিব বলেন, ‘আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার নামে পাকিস্তান সরকার মূলত দেখাতে চেয়েছিল তারা আমার একতরফা বিচার করছে না। আমাকে ডিফেন্ড করার জন্য সব সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানিরা মূলত আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর একটি সার্টিফিকেট তৈরি করতে চেয়েছিল।’

ডিসেম্বরের ৪ তারিখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বিচার কাজ শেষ হয়। দিনটি ছিল ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন। পূর্ব পাকিস্তান পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।

বিচার কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান সামরিক আদালতের সব সদস্যকে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান এবং জরুরিভাবে মামলার রায়ের খসড়া তৈরির আদেশ দেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান দেখলেন সামরিক কর্তকর্তারা রায় লিখবেন কখন, সবাই যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। যুদ্ধ-সংঘাতের মাঝে ইয়াহিয়া এ হাস্যকর রায় আর ঘোষণা করতে পারেনি।

৭ জানুয়ারি মুজিবকে লয়ালপুর থেকে মিয়ানওয়ালি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মিয়ানওয়ালি হচ্ছে লে. জে. এএকে নিয়াজীর জন্মস্থান। পাকিস্তানের সামরিক সরকার যুদ্ধের মাঝখানে জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার হিসাবে পাঠিয়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালি কারাগারে পাকিস্তানি কয়েদিদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাঙালিরা নিয়াজিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তাই পরদিন সকাল ৬টায় সেলের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তারাও শেখ মুজিবকে জেলের ভেতর পিটিয়ে মেরে ফেলবে। এ প্রস্তাব কয়েদিরা খুবই উৎসাহের সঙ্গে নিয়েছিল, কারণ কয়েদিদের প্রায় সবাই ছিল নিয়াজির মিয়ানওয়ালি জেলার বাসিন্দা। এ ভয়ানক খবর জানতে পারেন কারাগারের সুপারিনটেন্ডেন্ট।

মুজিব জেল সুপারের নাম বলতে পারেননি। কিন্তু জানান, এ ভদ্রলোক একইসঙ্গে মিয়ানওয়ালি জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন। তিনি ভোর ৪টায় চলে আসেন কারাগারে। এসে সেলের দরজা খোলেন। মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা শেখ মুজিব এত ভোরে সুপারিনটেন্ডেন্টকে দেখে জানতে চাইলেন তাকে কি ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে? মুজিবের এ শঙ্কার কারণ হচ্ছে কিছুদিন আগে তিনি দেখেছেন কর্মচারীরা জেলের অভ্যন্তরে কবরের মতো একটি গর্ত খনন করছে।

শেখ মুজিব জেল কর্মকর্তাকে বললেন, যদি ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে যেন তাকে শেষ নামাজ পড়ার জন্য কয়েক মিনিট সময় দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের প্রতি বন্ধুবৎসল এই জেল কর্মকর্তা অভয় দিলেন। বললেন, তিনি তাকে ফাঁসিতে নিচ্ছেন না, অন্যত্র নিয়ে যেতে এসেছেন। জেল কর্মকতা বলেন, ‘সময় নাই, এখনি আমার সঙ্গে যেতে হবে।’

কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জেল সুপার শেখ মুজিবকে চক্রান্তের কথা জানালেন। বললেন, তিনি মুজিবকে প্রায় এক মাইল দূরে তার নিজের বাড়িতে রেখে আসবেন-যাতে তার দেখা কেউ না পায়। সেখানে তিনি দুদিন থাকবেন। কারণ হিসাবে তিনি বললেন, যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। তাই সামরিক কর্মকর্তারা তাদের করণীয় নিয়ে বিভ্রান্ত। যে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই মুজিবকে বাঁচানোর জন্য এ ব্যবস্থা।

১৮ ডিসেম্বর জেল সুপার শেখ মুজিবকে জানালেন বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে। তাই তাকে সরে যেতে হবে। তিনি মুজিবকে নিয়ে চলে যান কয়েক মাইল দূরে আরেকটি খালি বাড়িতে। সৈন্যরা জেল সুপারের কাছে মুজিবের হদিস জানতে না চাওয়া পর্যন্ত ৯ দিন মুজিব এ বাড়িতে ছিলেন।

পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে জানতে চেয়েছিল মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে। কিন্তু জেল সুপার তাদের জানিয়েছিলেন মুজিব কোথায় আছেন তা তিনি জানেন না। এর মধ্যে ক্ষমতার মসনদে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সামরিক শাসকদের সরিয়ে প্রেসিডেন্টের পদে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।

১৯ ডিসেম্বর স্থানীয় থানার ওসি জেল সুপারকে বলেন, সামরিক বাহিনীর পতিত জেনারেলদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের নির্বাচিত জুলফিকার আলী ভুট্টো শাসনভার নেওয়ার পর মুজিবকে আর লুকিয়ে রাখার বা ভীত হওয়ার কোনো কারণ নাই। ওসি আরও জানান, ভুট্টো সাহেব মুজিবকে দেখতে চেয়েছেন এবং তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।

এরপর মুজিবকে মিয়ানওয়ালি থেকে রাওয়ালপিন্ডি আনা হয় এবং প্রেসিডেন্টের গেস্ট হাউসে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কয়েকদিন পর জুলফিকার আলী ভুট্টো গৃহবন্দি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এ ভুট্টোই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনগণের নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির ওপর সীমাহীন বর্বরতা ও নিপীড়নের পথনকশা তৈরি করেন।

ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে এলে মুজিব তাকে অভিনন্দন জানান এবং বলেন, তিনি শুনেছেন, ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, কিন্তু পিছুটানও দিচ্ছেন। ভুট্টো এখন কী করছেন তাও মুজিব জানতে চান। ভুট্টোর জবাব ছিল-‘আমি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। আমার জন্য সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি মুজিবকে এটাও জানান, ইয়াহিয়া খান তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় বলেছেন, তার বড় দুঃখ তিনি শেখ মুজিবকে শেষ করে দিয়ে যেতে পারেননি। যদি পারেন তার এই ‘ছোট কাজটি’ যেন আমি শেষ করি। ইয়াহিয়া খান কাগজপত্রে পেছনের তারিখ দিয়েও সই করতে চেয়েছিলেন, যাতে ভুট্টো বলতে পারেন মুজিবের ফাঁসি ইয়াহিয়াই দিয়ে গেছেন।

কিন্তু ইয়াহিয়ার অনুরোধ ভুট্টো রক্ষা করেননি। না করার কারণ ছিল রাজনৈতিক। কারণ, ভুট্টো যদি ইয়াহিয়ার এই ‘ছোট কাজটি’ সম্পন্ন করে, তাহলে বাঙালিরা বাংলাদেশে আত্মসমর্পণকারী এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্যের গলা কাটবে। এ সৈন্যদের অধিকাংশই পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বাসিন্দা। তারা এ জন্য ভুট্টোকে দায়ী করবে এবং ভুট্টোর নতুন সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে। ভুট্টোর ক্ষমতায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে।

কথার মধ্যেই ভুট্টো বারবার মুজিবকে দুই পাকিস্তানি অঞ্চলের মধ্যে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য বলেন। এর উত্তরে মুজিব ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমেই একটি বিষয় জানতে চাই। তা হচ্ছে আমি কি মুক্ত, নাকি বন্দি? যদি আমি মুক্ত হই, আমাকে যেতে দিন। যদি আমি মুক্ত না হই, তাহলে তো আমি কোনো কথা বলতে পারি না।’

তখন ভুট্টো বলেন, আপনি মুক্ত। কিন্তু আপনাকে যেতে দেওয়ার আগে আমার কয়েকদিন সময় প্রয়োজন। মুক্তির প্রতিশ্রুতি শোনার পরও মুজিব ভুট্টোর সঙ্গে কোনো বিষয়েই বিশেষ কোনো আলোচনা করেননি। ভুট্টো আরেকটি কথা মুজিবকে বলেছিলেন। তা হলো-পাকিস্তানের দুটি অংশ আইন, ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে এখনো অভিন্ন। তখন মুজিব ভুট্টোকে বিগত সাধারণ নির্বাচনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে জাতীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাকে সম্মান দেখানো হয়নি। আপনি যদি এখনো পাকিস্তানকে এক রাষ্ট্র মনে করেন, তাহলে তো আপনি প্রেসিডেন্ট এবং চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হতে পারেন না। আমিই হতে পারি।’

জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তৃতীয় এবং শেষবারের মতো শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে যান। তখন মুজিব তাকে বলেন, আপনার উচিত আমাকে আজ রাতেই মুক্ত করে দেওয়া। এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নাই। হয়তো আমাকে মুক্তি দিন, না হয় মেরে ফেলুন।

ভুট্টো মুজিবকে বলেন, এত সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশে মুক্তির আয়োজন করা কঠিন। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত মুজিবকে লন্ডন পাঠাতে রাজি হন। পরের দিন বিদায় জানানোর সময়ও ভুট্টো মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানান।

Pin It