সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার দুই যুগ পর আসামি আশীষ রায় চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব বলছে, ‘উচিৎ শিক্ষা’ দিতে এই চিত্রনায়ককে খুনের পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল।
ঢাকার গুলশানের একটি বাসা থেকে আশীষকে (৬৩) গ্রেপ্তারের পরদিন বুধবার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন সংস্থার আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের সামনে ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে অপমান এবং ক্লাবটি বন্ধ করতে সোহেল চৌধুরীর তৎপরতাই এই খুনের কারণে হিসেবে খুঁজে পেয়েছে র্যাব।
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সোহেলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার দিনই তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন।
ওই ঘটনায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে মামলা শুরু হলেও নথি গায়েব হয়ে যাওয়ায় বিচারে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।
দীর্ঘ বিরতি দিয়ে এখন নিম্ন আদালতে বিচার চলার মধ্যেই আইনের চোখে পলাতক আসামি আশীষকে গ্রেপ্তার করল র্যাব, যে বাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক বছর পর।
সংবাদ সম্মেলনে আল-মঈন বলেন, ১৯৯৬ সালে বনানীর আবেদীন টাওয়ারে আশীষ চৌধুরী ও আসাদুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম যৌথ মালিকানায় ট্রাম্পস্ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।
“প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ক্লাবে বিভিন্ন বয়সী মানুষ সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর রাত পর্যন্ত নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য আসত। পর্যায়ক্রমে এই ট্রাম্পস্ ক্লাবটি সকল আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন এবং গ্যাং লিডারদের একটি বিশেষ আখড়ায় পরিণত হয় এবং এখানে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের।”
আশীষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “আজিজ মোহাম্মদ ভাই মূলত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের চক্রগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিটিং বা তাদের পরিচালনা করার জন্য সেই ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করত এবং সেই ক্লাবকে ব্যবহার করত। সেই সুবাদে ট্রাম্পস্ ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম এবং আশীষ রায় চৌধুরীর সাথে তার সখ্য তৈরি হয়।
“আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাতিজিকে বান্টি ইসলাম বিয়ে করার সুবাদে তাদের মধ্যে একটি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল এবং বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় ছোটবেলা থেকে একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।”
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও এমবি ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাইর পরিচিতি বেশি চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবেই, এমবি ফিল্মসের কর্ণধার হওয়ায়।
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও চিত্রনায়ক সালমান শাহ হত্যামামলায় জড়িয়ে পড়া আজিজ মোহাম্মদ ভাই দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পালিয়ে আছেন। পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির মামলায়ও আসামি তিনি।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই ট্রাম্পস ক্লাবে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হয় বলে আশীষ জানিয়েছেন।
“পরবর্তীতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরীকে অনুরোধ জানায়।”
সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আশীষের বিরোধের প্রসঙ্গ তুলে ধরতে গিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “বনানীর আবেদীন টাওয়ারের অষ্টম তলায় অবস্থিত ট্রাম্পস্ ক্লাবের ঠিক পাশেই ছিল ওই সময়কার বনানীর সবচেয়ে বড় মসজিদ বা বনানী জামে মসজিদ।
“যেহেতু এই ট্রাম্পস্ ক্লাবে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সারারাত বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী বনানী মসজিদের কমিটিকে নিয়ে বারবার ট্রাম্পস্ ক্লাবের এই ধরনের অশ্লীলতা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।”
সোহেলের এ অবস্থানের কারণে ট্রাম্পস্ ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরীর ব্যবসায়িক স্বার্থে আঘাত আসে জানিয়ে মঈন বলেন, “অপরদিকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই যেহেতু আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেক্টিভিটি মেইনটেইন করার জন্য ঢাকায় ট্রাম্পস্ ক্লাবকে একটা সেইফ হাউজ হিসেবে বেছে নিয়েছিল, তার সেই স্বার্থেও আঘাত লাগে।
“আবার ইমনের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও যেহেতু অসামাজিক কার্যকলাপ করতে একমাত্র সেইফ হাউজ পেয়েছিল, ওই সময়ে যদি ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে তারা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ত।”
গত শতকের ৮০ এর দশকে এফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকার চলচ্চিত্রে এসেছিলেন সোহেল চৌধুরী। একই সময়ে আসা চিত্রনায়িকা পারভীন সুলতানা দিতির সঙ্গে সিনেমায় জুটি বেঁধে অভিনয়ের পর জীবনেও জুটি বাঁধেন তারা।
এরপর একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে দিতি ঢালিউডে তার আসন পাকাপোক্ত করলেও সোহেল হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে অকালেই হারিয়ে যান। দিতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালে মারা যান।
৩ কারণে সোহেল চৌধুরী খুন
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, “ট্রাম্পস্ ক্লাবে জনসম্মুখে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে সোহলে চৌধুরীর অপমান করার প্রতিশোধ, মসজিদ কমিটিকে উস্কে দেওয়ার পেছনে সোহেল চৌধুরীর হাত আর এই ক্লাবের ব্যবসার হুমকির পেছনেও সোহেল চৌধুরী।
“এই তিন কারণে সোহেল চৌধুরীকে উঠিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরী একটি পরিকল্পনা করে।”
ট্রাম্পস্ ক্লাবে সেসময়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল জানিয়ে র্যাব বলছে, আশীষ চৌধুরীদের পরিকল্পনায় ইমন এই হত্যাকাণ্ড ঘটান।
১৯৯৮ সালে সোহেলকে হত্যা করার দিনই তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলার তদন্ত শেষে ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
অভিযোগপত্রে আসামির তালিকায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশীষ চৌধুরী, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, আদনান সিদ্দিকী, তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ও ফারুক আব্বাসী।
এই মামলায় আশীষ চৌধুরী শুরু থেকেই পলাতক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও ছিল।
বিদেশে থাকা আজিজ মোহাম্মদ ভাই ছাড়াও বান্টি ইসলাম, সেলিম খান, ইমনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
এই মামলায় ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার দায়রা জজ আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। এরপর মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০০৩ সালে ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে পাঠানো হয়।
কিন্তু এক আসামির পক্ষে হাই কোর্টে মামলাটি বাতিল চেয়ে আবেদন করা হলে আদালত একটি রুল দেয়; সেই সঙ্গে বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ আসে।
এরপর দীর্ঘদিন মামলাটির নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সবার নজরে আসে। তারপর বিচারিক আদালতে পুনরায় বিচার শুরু হয়। এখন ঢাকার আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
কানাডা পালাচ্ছিলেন আশীষ
র্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, আশীষ রায় চৌধুরীর নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলে ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কানাডায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
আশীষকে মঙ্গলবার রাতে গুলশান এক নম্বর সেকশনের এক বাসা থেকে গ্রেপ্তারের সময় ২৩ বোতল বিদেশি মদ, কয়েক ক্যান বিয়ার উদ্ধারের কথাও জানায় র্যাব।
পরিচিত মহলে ‘বোতল চৌধুরী’ হিসেবে পরিচিত আশীষ দেশে থেকেই এতদিন নামি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে আসছিলেন বলে র্যাবের ভাষ্য।
এক প্রশ্নের জবাবে মঈন বলেন, “এতদিন তিনি (আশীষ) বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর ওই বাসায় আত্মগোপনে চলে যায়।
“ওই বাসাটি একটি পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঠিক করে দিয়েছিল।”
তবে ওই হোটেলের নাম বলতে রাজি হননি র্যাব কর্মকর্তা মঈন। তিনি বলেন, “আশিষ রায় চৌধুরী এই তথ্য দিয়েছেন। তবে তার দেওয়া কথা ও তথ্য আমরা যাচাই-বাছাই করছি।”
পলাতক অন্য আসামিদের সঙ্গে আশীষের যোগযোগ রয়েছে দাবি করে আল-মঈন বলেন, “ব্যাংককে পালিয়ে থাকা আজিজ মোহাম্মদ ভাই, কানাডায় পালিয়ে থাকা বান্টি ও আমেরিকায় পালিয়ে থাকা আদনানের সঙ্গে আশীষ রায় চৌধুরীর যোগাযোগ রয়েছে।”
এই মামলায় লেদার লিটন, ইমন, তারেক সাইদ ও ফারুক কারাগারে রয়েছে। আর সেলিম নামে একজন পরোয়ানাভুক্ত আসামি এখনও অধরা বলে জানান তিনি।