অর্থনীতিতে পাটের সম্ভাবনা বাড়ছে

image-544326-1650657202

দেশের অর্থনীতিতে আবারও পাটের সম্ভাবনা বাড়ছে। গার্মেন্টসনির্ভর রপ্তানি খাতকে বহুমুখী করতে সামনে আসছে এক সময়ের গৌরবের সোনালি আঁশ পাট। পাশাপাশি বিশ্বে পরিবেশবান্ধব শিল্প হিসাবেও বাড়ছে পণ্যটির চাহিদা।

আগ্রহ বাড়ছে দেশি বিদেশি উদ্যোক্তাদের। ফলে দায়গ্রস্ত শিল্পটি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করছে সরকার। বাংলাদেশে পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারের পর নতুন করে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে নানা উদ্যোগের কথা বলছে সরকার।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে পাট খাতের চাহিদায়। এ কারণে পাট নিয়ে ধীরগতিতে আগানোর পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ খাতে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি। জানতে চাইলে তত্ত্বাধবায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জন্মরহস্য আবিষ্কার হওয়ায় পাটের সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। বিশ্ববাজারেও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। ফলে এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এ খাতে বিনিয়োগ জরুরি। তিনি বলেন, এ খাতে গবেষণা আরও বাড়াতে হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে অর্থনীতির অন্যতম দায় দেশের পাট খাত। মুনাফাতো দূরের কথা, এ খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে ১০ বছরে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এ সময়ে লোকসান দিয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

দুর্নীতি অনিয়মসহ নানা সীমাবদ্ধতায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় ২০২০ সালের ৩০ জুন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) বন্ধ হয়ে যাওয়া ১৭টি জুট মিল ইজারার মাধ্যমে সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে দুটি চালু হয়েছে। চালু হওয়ার পথে আরো দুটি। বাকি ১৩টি মিল ইজারায় নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ১৮টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাট খাতের এই দুরবস্তার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, অদক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, শ্রমিক ইউনিয়নের স্বেচ্ছাচারিতা, সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাব এবং সরকারের অবহেলা। তবে সম্ভাবনাও কম নয়। কারণ বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের।

এর মধ্যে চীনের দখলে অধিকাংশ বাজার থাকলেও বাংলাদেশের অবস্থান আছে ছোট আকারে। তবে ২০১৮ সালে ইউরোপের বাজারে সিনথেটিক পণ্য নিষিদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বাড়ছে বায়োডাইবারসিফিকেশন ব্যাগ ও পণ্যের চাহিদা যা বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে দেশীয় পাটের জন্মরহস্য আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ফলে জীবাণু প্রতিরোধক পাট উৎপাদন করা সম্ভব হবে। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতেই নানা উদ্যোগ। এদিকে পলিথিনের মোড়ক ব্যবহার করে পণ্য বাজারজাত করে এমন কোম্পানির ওপর এক শতাংশ ইকো ট্যাক্স আরোপ করা হয়। অবৈধ পলিথিন নির্মূল ও পলিথিন রি-সাইক্লিংয়ের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১১৬ দশমিক ১৪ লাখ ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪২ কোটি ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৬ কোটি ডলার বেশি। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে প্রতি বছর ১২ দশমিক ৩৫ লাখ একর জমিতে পাট চাষ হয়। মোট উৎপাদনের ৭৫ শতাংশই দেশে ব্যবহার হয়।

জানা গেছে, ২০০টি পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতায় ২২টি, বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) আওতায় ৮১টি এবং বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় ৯৭টি। সরকারি হিসাবে তিন খাতে মোট শ্রমিক এক লাখ ৫৬ হাজার ৫৪৯।

১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আদমজী পাটকল। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে গড়ে ওঠে অনেক পাটকল যার বেশির ভাগই ছিল লাভজনক। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথমে ৬৭টি পাটকলকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। পরে আরও ৮২টি পাটকল সরকারি করে বিজেএমসির আওতায় আনা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর নেতৃত্ব ও কর্মপরিকল্পনায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কখনো নেওয়া হয়নি, যা ক্রমশ পাটকলগুলোকে দুর্বল করেছে।

সূত্র আরও জানায়, দেশে পাট খাতে এখন বেশ সাড়া মিলেছে। এ জন্য প্রায় এক দশক পরে নীতিমালা তৈরি হয়েছে। এই নীতিতে বন্ধ হওয়া সরকারি পাটকলগুলো ক্রমান্বয়ে চালুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার এবং পাটপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

পাটবীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় বিএডিসির সক্ষমতা বাড়ানো, পাটচাষিদের অর্থ সংকট লাঘবে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, বিক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাটচাষিরা অর্থ পেয়ে যান-এসব বিষয় পাটনীতিতে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হচ্ছে।

বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, আইভোরি কোস্ট, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, জার্মানি, স্পেন, ইংল্যান্ড, মিসর, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। দেশের ভেতরেও পাটজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে বেসরকারি পাটকলগুলো। তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি এ খাতে সমস্যাও কম নেই।

উন্নত জাতের বীজ, আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, দক্ষ শ্রমিক, পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও বিপণন কৌশলের অভাব রয়েছে পাটশিল্পে। সহযোগিতাও নেই পাট গবেষণায়। এসব দিকে এখনই নজর না দিলে বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য গুরুত্ব দিতে হবে বীজ উৎপাদনে। কারণ মানসম্মত বীজের অভাব রয়েছে।

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে সাড়ে ১২শ টন উৎপাদন হলেও পাটবীজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় পাঁচ হাজার টন। ফলে ভারত বা চীন থেকে প্রতি বছর বীজ আমদানিতে চলে যাচ্ছে বড় অঙ্কের অর্থ। তবে পাট খাতে সরকারি বিনিয়োগে অসন্তোষ অবস্থানে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

এ সংস্থার মতে, অদক্ষতা, লুটপাট, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে লোকসানি মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে নতুন করে পাটের পুনর্জাগরণের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

Pin It