পরাণ কতটা পরাণ জুড়াল ?

poran-poster-150722

বহুদিন পরে হলে ফেরা দর্শকের হাততালি দেওয়া এক সিনেমার নাম ‘পরাণ’ !

শুরুতে ‘যতই বলা হোক এই সিনেমার কাহিনি পুরোটাই কাল্পনিক, বাস্তব কোনো ঘটনার সঙ্গে মিলে গেলে সেটা নিতান্তই কাকতালীয়’-মানুষ তত বেশি বিশ্বাস করেছে যে এটা বরগুনার নয়ন বন্ড ও রিফাতের হত্যাকাণ্ড এবং মিন্নির ফাঁসি রায়ের সেই আলোচিত ঘটনা নিয়ে নির্মিত।

মানুষ বিশ্বাস করেছে যে এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। মানুষ তার জানা গল্পের সময়োচিত নির্মাণ দেখতেই হলে গেছে এবং আলোচিত সেই ঘটনা নিয়ে নির্মিত সময়োচিত এক রুদ্ধশ্বাস সিনেমারই নাম পরাণ। অভিনেতা অভিনেত্রীদের উজাড় করে দেওয়া অভিনয় আর আধুনিক নির্মাণের এক আলোচিত চলচ্চিত্র ‘পরাণ’।

‘মুড সুইং’ করা এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ের নাম অনন্যা। সে দুবার ফেল করেছে এসএসসিতে। কলেজেও তার পড়ালেখার হাল ছিল এমনই। অনন্যার বাসার সামনে মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, নেশা করে ‘পিনিক’ নিয়ে চলা, বখে যাওয়া এক ছেলের নাম রোমান। রোমান আবার স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যবহৃত ‘ক্যাডার’। তাকে ব্যবহার করে, তাকে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেমালুম পেটায় এক নারী রাজনীতিবিদ। তিনি মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। সারাদিন নেশা করতে থাকা এই রোমান আবার অনন্যার সামনে এক শিশুসুলভ প্রেমিক। সে সবকিছুর বিনিময়ে ভালোবাসা চায় অনন্যার। অনন্যা সুযোগটা লুফে নেয়। পড়ালেখা করতে তার ভালো লাগে না। রোমানের চড় চাপ্পট খেয়ে ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটা অনন্যাকে সালাম দিয়ে তাকে নোট দিয়ে যায়, পরীক্ষার সময় নকল সাপ্লাই দেয়। অনন্যার ফেল করার ঘরানা থেকে বেরিয়ে ‘ভালো রেজাল্টের’ যুগে চলে আসে! তার রোমানের সঙ্গে প্রেম জমে ওঠে। রোমানকে সে ডাকে ‘পরাণ’! তারা ঘুরতে যায়, চটপটি খায়, গান গায়। কিন্তু একদিন (নয়ন বণ্ড আর মিন্নির জীবনে রিফাতকে আনার জন্যই হয়ত) অনন্যা ভর্তি হয় ইউনিভার্সিটিতে।

সিনেমার কাহিনি বা লোকেশান অনুসারে অনন্যার বাসা, কলেজ আর ইউনিভার্সিটি হয়ত একই এলাকায়! সে যাই হোক, কলেজের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটার নাম সিফাত। সে কলেজে টিউশানি করে চলে। বন্ধুবান্ধবকে পড়ানোর দৃশ্য ভালো লেগে যায় অনন্যার। সে সিফাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। ‘গুডি গুডি বয়’ সিফাত তাকে পাত্তা না দিলে অনন্যা আবার রোমানের শরণাপন্ন হয়। রোমান ও তার দুই ‘ক্যাডারের’ হুমকি-ধমকিতে সিফাত অনন্যাকে পড়াতে রাজি হয়। অনন্যার ‘মুডসুইং’ প্রবণতায় নতুন ভালো লাগার শিকার হয় সিফাত। সে সিফাতের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে! রোমানের সঙ্গে প্রেমের ঘটনার মতো সিফাতের সঙ্গে প্রেমের কাহিনিও এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রোমান অনন্যার মুখোমুখি হলে অনন্যা রোমানকে প্রথমে রাজনীতি ও পরে নেশা ছেড়ে দিতে বলে। রোমান শুধু অনন্যাকে পাওয়ার জন্য রাজনীতির বিরুদ্ধ স্রোতে হেঁটে একেবারে সর্বশান্ত হয়। তার মাথার উপর থেকে রাজনীতির ছায়া সরে যায়।

অন্যদিকে সিফাতকে সাতদিনের মধ্যে বিয়ে করতে বলে অনন্যা, তিন মাসের ভেতর দেশের বাইরে নিয়ে যেতে বলে। অনন্যাকে পেতে সিফাত সেটাই করতে রাজি হয়। ততদিনে রোমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়, সে ফেরারী জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। সে লুকিয়ে যখন অনন্যার সঙ্গে দেখা করতে আসে, অনন্যা তখন তার সঙ্গে পালিয়ে যেতেও রাজি হয়। সে রাতে না এসে পরদিন ভোরে আসে রোমানের সঙ্গে দেখা করতে, সঙ্গে পুলিশ নিয়ে আসে! ধরা পরে যায় রোমান, খবরের শিরোনাম হয় সে। রোমানের ‘ক্যাডাররা’ তাকে সেই নারী রাজনীতিবিদের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে বলে। রোমান রাজি না হয়ে জেলে বা হাজতে (ছবিতে স্পষ্ট নয়) যায়! এর মাঝেই অনন্যা ও সিফাতের বিয়ে হয়ে যায়। জেলে বা হাজতে বসে রোমান সেই খবর পায়। বিয়ের পর আবারও মুড সুইং হয় অনন্যার, সারাক্ষণ বই নিয়ে থাকা গুডি গুডি বয় সিফাতকে তার কেমন যেন লাগে! চটপটি খেতে গেলে এক যুবক যখন অনন্যার গায়ে হাত দেয়, সিফাত যখন প্রতিবাদ করতে পারে না, অনন্যার তখন রোমানের কথাই মনে পড়ে! সে স্বামীকে ঘুমন্ত রেখে রোমানের সঙ্গে দেখা করতে যায়। শিশুসুলভ প্রেমিক বন্দি রোমান তখনও অনন্যাকে নিয়ে পালাতে চায়।

‘ছবির কাহিনি কোন বাস্তব ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়’ এটা প্রমাণ করতেই হয়ত শেষে কাহিনী একটু বদল করা হয়েছে।

বরগুনার মিন্নির প্রেমিক নয়নবন্ড নিহত হয়েছিলেন কথিত ‘ক্রসফায়ারে’। সিনেমার শেষ কয়েকটি দৃশ্য অনুসারে কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে পালায় রোমান। সে ফিরে এসে কলেজের সামনে পেয়ে যায় অনন্যা ও সিফাতকে। অনন্যাকে রোমান নিয়ে যেতে চাইলে বাধা দেয় সিফাত। সিফাতের ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া রোমান ডাব কাটার দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করে সিফাতকে এবং পালাতে সক্ষম হয়। এরপর আবারো মুড সুইং হয় অনন্যার। সে রোমানের ঘনিষ্ঠ ক্যাডার ‘তুতু’ (যে কিনা সব সময় ‘ত’ দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করে) কে বলে রোমানকে খুন করতে। তুতু পালিয়ে থাকা, খেতে না পারা রোমানের সঙ্গে দেখা করে, বিরিয়ানি খাইয়ে তাকে গুলি করে মারে। ছবির শেষে জেলে যায় অনন্যা ও তুতু।

পরের দৃশ্যে কী হবে? এটা জানার জন্য দর্শকের উত্তেজনা সারা সিনেমাজুড়েই ছিল। ছিল গল্পের টানটান উত্তেজনা কিংবা স্ক্রিপ্টের মুন্সিয়ানা। এই সিনেমার সবচেয়ে ভালো দিক গল্প বলার ভঙ্গি।

পরিচালক রায়হান রাফি এই ছবির জন্য বহুদিন দর্শকদের হৃদয়ে থাকবেন। তার পুরোনো সিনেমা দেখে তাকে যতটা সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে, এই সিনেমায় তিনি সব প্রত্যাশা যেন পূরণ করতে পেরেছেন। চিত্রনাট্য করেছেন রায়হান রাফি ও শাহজাহান সৌরভ।

এই সিনেমার আরেক ভালো দিক অভিনেতা অভিনেত্রীদের অসাধারণ অভিনয়। কার কথা আগে বলা যায়? পাঁচ ছয়জন মানুষ যেন অভিনয়কে শিল্পে পরিণত করেছেন। রোমানের চরিত্রে শরীফুল রাজ আর অনন্যার চরিত্রে বিদ্যা সিনহা মীম তাদের জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন। বখে যাওয়া আর নেশা করা চরিত্রে শরীফুল রাজ ছিলেন ভিন্নমাত্রার! আরেক দুর্দান্ত অভিনয় করা শিল্পীর নাম নাসিরুদ্দিন, যিনি পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি কিনা ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজেও দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। গুডি গুডি বয় সিফাত চরিত্রে ইয়াশ রোহানও দারুন অভিনয় করেছেন। ‘ত’ দিয়ে সব শব্দ বলে যাওয়া রাশেদ মামুন অপুও ছিলেন দুর্দান্ত! তার গালি শুনেও হেসেছে মানুষ, রোমানকে খুনের দৃশ্যে অন্যরকম এক অপুকে আবিষ্কার করেছেন দর্শক। খল চরিত্রের নারী রাজনীতিবিদ হিসেবেও ভালো করেছেন রোজী সিদ্দিকী, ভালো করেছেন অনন্যার বাবা মার চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম ও শিল্পী সরকার অপু।

সিনেমার গানগুলোতে সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন নাভেদ পারভেজ ও ইমন চৌধুরী। চারটি গান ব্যবহৃত হয়েছে । জনি হকের লেখা এবং আতিয়া আনিসা ও অয়ন চাকলাদারের গাওয়া ‘চলো নিরালায়’ গানটি ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে। সিনেমার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে প্রচলিত একটি গানের ব্রিজলাইন-‘সাজিয়ে গুছিয়ে দে মোরে সজনী তোরা’ কয়েকবার ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া ‘জ্বলেরে পরাণ’ গানটি গেয়েছেন এপি শুভ (গীতিকার তাহসান শুভ ও ওয়াসিক সৈকত) এবং রবিউল ইসলাম জীবনের লেখা, ইমন চৌধুরী ও জিনিয়া জাফরিন লুইপার গাওয়া ‘ধীরে ধীরে’ গানটিও আছে সিনেমাটিতে।

২০১৯ এ শুটিং শুরু হলেও পরাণ মুক্তি পায় ১০ জুলাই ২০২২ এ মাত্র ১২টি হলে। এটি দারুণ মাত্রার ব্যবসা সফল ও জনপ্রিয় সিনেমা হবে বলেই হল থেকে ফেরা দর্শকের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয়েছে। রায়হান রাফিসহ এই সিনেমার সব অভিনেতা অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পীসহ সবাইকে বিশেষ শুভেচ্ছা জানানো যেতে পারে।

জয় হোক বাংলা সিনেমার।

Pin It