মধ্যরাতেও লোডশেডিং !

image-604159-1665442878

উপদেষ্টা-প্রতিমন্ত্রী কেউ কথা রাখেননি, ডিসেম্বরের আগে কাটছে না আঁধার * গ্রামে বিদ্যুতের শিডিউল বিপর্যয়, ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না অনেক গ্রামে ।

পঁচিশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দেশ বাংলাদেশে এখন মধ্যরাতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। কখনো রাত ২টা, কখনো ভোররাতে আচমকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ছে ঢাকা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থায়ী হচ্ছে সেই লোডশেডিং। তীব্র গরমে এ সময় চরম নাভিশ্বাস উঠছে অসহায় নারী, শিশু ও অসুস্থ মানুষের। এক ঘণ্টার কথা থাকলেও খোদ ঢাকায় এখন ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকার বাইরে অনেক গ্রামে এখন বিদ্যুতের দেখাই মেলে না।

দিনে-রাতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টাও লোডশেডিং করা হয় বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলে। বিদ্যুৎ না থাকায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষকের সেচ কার্যক্রম। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিদ্যুতের এই লোডশেডিং নিয়ে কেউ কথা রাখেননি। উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সচিব কারও কথায় মিল নেই লোডশেডিং নিয়ে। সর্বত্রই শিডিউল বিপর্যয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নভেম্বর পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে বলেছেন দেশবাসীকে। নভেম্বরের পর পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হতে পারে বলে তিনি আশ্বস্ত করেছেন। তার মতে, গ্যাস সংকটের কারণে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে আছে। লোড বেশি হওয়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২৪ ঘণ্টা চালানো যাচ্ছে না। যখন ওই কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকে বাধ্য হয়ে তখন লোডশেডিং করতে হয়। তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে লোডশেডিং না করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারিনি। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি। তিনি আশা করছেন আগামী মাস থেকে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হতে পারে। তিনি এই সময়ের জন্য দেশবাসীকে ধৈর্য ধরারও আহ্বান জানিয়েছেন।

বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ঘোড়াশালে গ্রিড বিপর্যয়ের পর পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় ৯শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে না। বিপর্যয়ের পর সেখানে মেরামতের কাজ চলছে। তিনি আশা করছেন আজকের (সোমবার) মধ্যে এই মেরামত কাজ শেষ হলে ঢাকার পরিস্থিতি আরও অনেক উন্নতি হবে। সোমবারের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিলম্ব হওয়ায় লোডশেডিং বেড়ে গেছে। তিনি আশা করছেন আজকের মধ্যে এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। বিদ্যুৎ সচিব আরও বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এ কারণে দেশব্যাপী লোডশেডিং বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী তীব্র জ্বালানি সংকটের কারণে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তবে তিনি আশা করছেন আগামী মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কারিগরি ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি স্বল্পতা ও অন্যান্য কারণে ১৩৩ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১১৭টি কেন্দ্র বন্ধ আছে। এর মধ্যে কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ ৩১টি, রক্ষণাবেক্ষণে ১৫টি, জ্বালানি স্বল্পতার কারণে ৫৭টি এবং অন্যান্য কারণে বন্ধ আছে ১৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যার কারণে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৯ হাজার ৫৩৭ মেগাওয়াট থাকলেও গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে মাত্র ৯৫২২ মেগাওয়াট। পিক আওয়ারে এটি বেড়ে সর্বোচ্চ ১২২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত করা যায়। ৯ অক্টোবর দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩৮০০ মেগাওয়াট। তাতে ঘাটতি ছিল ৪২৭৮ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বেসরকারি হিসাব মতে, এখন প্রতিদিন গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। তাতে প্রতিদিনই গড়ে ঘাটতি থাকছে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। যার কারণে দেশব্যাপী তীব্র লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

এদিকে ঢাকার লোডশেডিং পরিস্থিতি সহনীয় করতে সোমবার সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠকে বিদ্যুৎ সচিব, পিডিবি চেয়ারম্যান, ঢাকার দুই বিদ্যুৎ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকোর দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করা যায় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যরাতে লোডশেডিং না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ডিপিডিসি ও ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, এখন প্রতিদিন গড়ে তাদের চাহিদা ১৭শ মেগাওয়াট। কিন্তু তারা পাচ্ছে গড়ে ১১শ থেকে ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় তাদের লোডশেডিং বেশি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে রাতের বেলায় মাঝে মাঝে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে মধ্যরাতেও তাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে বিতরণ লাইনে ত্রুটির কারণে রাতের বেলায়ও লোডশেডিং করতে হয়। একই অবস্থা ডেসকোতেও। তারাও গড়ে আড়াইশ থেকে ৩শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। যার কারণে দিনে রাতে গড়ে ৫ থেকে ৭ বার লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে গ্রামে। সরকার গ্রামে ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের কথা বললেও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতাধীন ৭০টি সমিতির অধিকাংশতে গড়ে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। সমিতিগুলোর কেউই সরকারের নির্দেশনা মানছে না।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের একের পর এক লোডশেডিংয়ের কারণে আবাসিক গ্রাহকের পাশাপাশি মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প মালিকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ায় তারা কারখানা চালাতে পারছেন না। ফলে শিল্পোৎপাদনে ধস নেমেছে। দিনের বেলায় বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এখন রাতেও কারখানা চলে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় সামাল দিতে পারছে না। গ্রামে গ্রামে ডিজেল সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে সেচসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।

এছাড়া পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) আওতায় ৪টি অফগ্রিড এলাকায় ও পার্বত্য অঞ্চলের ২৬টি উপজেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করা হচ্ছে। খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে কাজ করছে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, রংপুর-রাজশাহী অঞ্চলে আছে নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। আরইবির সমিতিগুলোর অভিযোগ, তারা প্রতিদিন চাহিদার অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এ কারণে তারা সরকারি শিডিউল মানতে পারছেন না। তাদের বক্তব্য, সাধারণ সময়েও সমিতিগুলো গড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং করে থাকে। এখন বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে গিয়ে তাদের প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এছাড়া নানা কারণে প্রতিদিন একাধিকবার লাইন ট্রিপ হয়। গ্রাহকরা সেটাকেও লোডশেডিং বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।

সোমবার বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদের বিভিন্ন ফিডারগুলোতে সর্বনিম্ন ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং করার শিডিউল দিলেও বাস্তবে ছিল আরও বেশি। সমিতির এক কর্মকর্তা বলেন, রোববার পিক আওয়ারে তারা অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ পেয়েছেন। ফলে তাদের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সোমবার তারা গড়ে ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং করেছে দিনের বেলায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সোমবার মাত্র ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেয়েছে। অথচ চাহিদা প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট। এ কারণে তারা ৮ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের শিডিউল দিলেও বাস্তবে আরও বেশি করতে হয়। বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রতিদিনের চাহিদা ৫০ থেকে ৭২ মেগাওয়াট। কিন্তু তারা পাচ্ছেন গড়ে ২০ মেগাওয়াটের কম। এ কারণে তাদের শিডিউল ভেঙে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

সিলেটে শহরের চেয়ে গ্রামে বিদ্যুতের লোডশেডিং প্রায় দ্বিগুণ। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দেওয়া তথ্যমতে, সব উপজেলাতেই দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ থাকছে না। একদিকে দাবদাহ অন্যদিকে লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে জনজীবন। সিলেটের ১৩ উপজেলা পল্লী বিদ্যুতের দুটি সমিতির আওতাভুক্ত। সমিতি ১-এর মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী সোমবার জানান, চাহিদার তুলনায় ৪৫ শতাংশ বিদ্যুৎ পাচ্ছেন তারা। সকালে চাহিদা ছিল ৭৭, পেয়েছেন ৪৫ মেগাওয়াট। দুপুরের দিকে ৭৯ মেগাওয়াটের বিপরীতে পেয়েছেন ৫০। তিনি জানান, ৮ উপজেলায় দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। যেসব এলাকায় হাসপাতাল ও শিল্পকারখানা রয়েছে সেখানে একটু কম করার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রামে দুঃসহ গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং থাকার কারণে মানুষের অবস্থা কাহিল। প্রতিদিন ১ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বিদ্যুৎ বিভাগ অফিসিয়ালি জানালেও বাস্তবে দুই থেকে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। নগরীর চেয়ে উপজেলাগুলোতে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। চট্টগ্রামে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে পিডিবি জানিয়েছে। সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে দিনে ও রাতে ১৩০০ থেকে ১৪০০ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ঘাটতি থাকছে।

Pin It