ঘুমের মান ভালো করার জন্য অনেক কিছুই করা যেতে পারে। ঘুমানোর সময়ের এক ঘণ্টা আগে থেকে মোবাইল চালানো বন্ধ করা, ঘরের তাপমাত্রা আরামদায়ক হওয়া, সন্ধ্যার পর থেকে আর কফি পান না করা ইত্যাদি।
শোবার ঘর অন্ধকার হওয়াও এই তালিকায় আছে। আর এই অন্ধকার আসলে কতটুকু হওয়া জরুরি? বিজ্ঞানভিত্তিক সাময়িকী ‘পিএনএএস’য়ে প্রকাশিত গবেষণায় এর উত্তর মিলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি’র ‘ফাইনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিন’ এই গবেষণা চালায়। দেখা গেছে, রাতে ঘুমানোর সময় খুব সামান্য আলোও ঘুমন্ত ব্যক্তির হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপকে ব্যাহত করে এবং সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তার ‘ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স’ বেড়ে যায়।
শুধু ঘুমের সময়ই নয়, সন্ধ্যার পর থেকে একজন মানুষ যত বেশি আলোতে সময় কাটাবে তার বিপাক প্রক্রিয়ায় ততই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে ‘গ্লুকোজ টোলারেন্স’ ও ‘ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স’ কমে।
অর্থাৎ সন্ধ্যার পর তীব্র আলোতে সময় কাটালে রাতে ঘুমের সমস্যার সঙ্গে কিছু শারীরিক সমস্যাও সৃষ্টি হবে।
কেনো এমনটা হয় তার কারণ হিসেবে গবেষকরা জানান, আলোতে থাকলে মস্তিষ্ক ধরে নেয় এখন হল জেগে থাকার সময়। আর অন্ধকারে থাকলে মস্তিষ্ক তাকে ধরে নেবে বিশ্রাম নেওয়া সময় হিসেবে।
আলোর সংস্পর্শে আসলে ‘সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (এসএনএস)’ সক্রিয় হয় যা হৃদস্পন্দের গতি বাড়ায় যাতে মানুষ সক্রিয়ভাবে যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তৈরি থাকে।
অন্ধকারে গড়িয়ে এলে সক্রিয় হয় ‘প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (পিএনএস)’। এখানে হৃদস্পন্দনের গতি ধীর হয়, মস্তিষ্ক নিঃসরণ করে মেলাটোনিন হরমোন, যা পুরো শরীরকে ইঙ্গিত দেয় যে এখন বিশ্রাম করার সময় এসেছে।
তাই রাতে ঘুমানোর সময় বা তার আগে আলো স্বাভাবিক নিয়মে বিশৃঙ্খলা আনে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্লিপলেস ইন নোলা’র সনদস্বীকৃত ‘পিডিয়াট্রিশন অ্যান্ড স্লিপ কনসালটেন্ট’ ও ‘স্লিপ ফাউন্ডেশন ডট অর্গ’য়ের ‘মেডিকাল রিভিউ এক্সপার্ট ডা. নিলং ভাইয়াস বলেন, “মস্তিষ্কের যে অংশ শরীরের ‘সার্কেইডিয়ান রিদম’ (ঘুম জাগরণের ছন্দ) নিয়ন্ত্রণ করে, তার সঙ্গে চোখ সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। চোখে কতটুকু আলো প্রবেশ করছে তার ওপর ভিত্তি করেই সার্কেইডিয়ান রিদম নিয়ন্ত্রিত হয়। যে কারণে আসলে ঘুম ভালো হবে নাকি খারাপ- তা নির্ধারিত হয়।”
এই গবেষণার সূত্র ধরে রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “শরীর যখন ঘুমানোর চেষ্টা করছে তখন যদি চোখে আলো আসে তবে ঘুম একটানা হবে না।”
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা আলো, বিছানার পাশে থাকা নাইট-ল্যাম্প’য়ের মৃদু আলো এগুলোও কি ঘুমের সমস্যা করতে পারে? গবেষণা বলছে, “হ্যাঁ”।
এই গবেষণার জন্য একদল তরুণ স্বাস্থ্যবান মানুষকে বেছে নেওয়া হয়। এক রাতে তাদের ঘুমাতে দেওয়া ৩ লাক্স পরিমাণ আলোয় আলোকিত একটি ঘরে।
আরেক রাতে তাদের ঘুমাতে দেওয়র ১০০ লাক্স পরিমাণ আলোকিত ঘরে।
দুই রাতেই বের করা হয় তাদের ঘুমের মান, হৃদস্পন্দনের গতি, রক্তে শর্করার মাত্রা।
দেখা যায় আলোকিত ঘরে ঘুমালে, ঘুমের মধ্যে হৃদস্পন্দনের গতি তুলনামূলক বেশি থাকে। আর ‘সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম’ সক্রিয় হয়ে যায়। পাশাপাশি পরদিন সকালে রক্তে শর্করার মাত্রাও বেশি থাকে।
তাই রাতে যে ঘর ঘুমানোর, তা যত বেশি অন্ধকার হবে ততই ভালো।
ডা. ভাইয়াস বলেন, “অন্ধকারে ঘরে ঘুমানো শরীরের ‘কার্ডিওমেটাবোলিক হেল্থ’য়ের জন্য খুবই জরুরি। যদি আলোতে ঘুমানোর অভ্যস্ততা তৈরি হয় তবে ধীরে ধীরে ঘুমানোর সময় ঘরে আলোর মাত্রা কমানো চেষ্টা করতে হবে।”
আর সেসব করার উপায়ও দিয়েছেন তিনি।
টেলিভিশন চালিয়ে রেখে ঘুমানো যাবে না। শোবার ঘরে অপ্রয়োজনীয় আলো সৃষ্টি করে এমন কোনো যন্ত্র রাখা যাবে না। আর থাকলেও তা অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে।
ঘরে ‘ব্লাকআউট’ পর্দা ব্যবহার করতে হবে। অস্বস্তি না হলে ‘স্লিপ মাস্ক’ বা চোখ ঢেকে রাখার মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
রাতে শোবার ঘরে যদি আলো রাখতেই হয় তবে খুব মৃদু আলো হতে হবে সেটা। সাদা ও নীল আলো রাখা যাবেনা।
বাদামি, লাল, কমলা এসব রংয়ের আলো রাখা যেতে পারে।