সিজদায় লুটিয়ে ঐতিহাসিক বিজয় উদযাপন মরক্কোর

image-623955-1670695286

উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো। বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলাই যাদের জন্য অনেক বড় অর্জন।কিন্তু কাতারে যেন ইতিহাস গড়তেই এসেছে আরব-আফ্রিকান দেশটি। একে একে তারা পৌঁছে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। তবে সেখানেই থামেনি তারা। বরং এবার তারা যা করল, তা ইতিহাসকেও হার মানিয়েছে। জন্ম দিয়েছে আফ্রিকান রূপকথার। সেই সঙ্গে আরব দেশগুলোর ফুটবল-বিপ্লবেও নেতৃত্ব দিচ্ছে মরক্কানরা।

২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আজ আল থুমামা স্টেডিয়ামে পর্তুগালকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে মরক্কো। এই জয় তাদের ইতিহাসে স্থায়ীভাবে জায়গা করে দিয়েছে। কারণ প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠলো মরক্কানরা। এর আগে আফ্রিকান দলগুলো বড়জোর কোয়ার্টার পর্যন্ত উঠতে পেরেছিল। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুন, ২০২২ বিশ্বকাপে সেনেগাল এবং ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানা শেষ আট থেকে বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু মরক্কো তাদের সবার কীর্তি ছাড়িয়ে গেল।

মরক্কোর কীর্তিগাঁথা যুগ যুগ ধরে আফ্রিকান ফুটবলে উচ্চারিত হবে। এর শুরুটা তারা করেছে গ্রুপ পর্বে। প্রথমেই তারা ২০১৮ বিশ্বকাপের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়াকে রুখে দেয়। গোলশূন্য ড্রয়ে শেষ হয় ম্যাচটি। এরপর ফিফা র্যাং কিংয়ের এক নম্বর দল বেলজিয়ামকে হারায় ২-০ গোলে। শেষ ম্যাচে কানাডাকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠে শেষ ষোলোয়। তাদের কারণে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় বেলজিয়ানরা।

শেষ ষোলোয় মরক্কোর শিকার হয়ে বিদায় নেয় ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী স্পেন। টাইব্রেকারে গড়ানো ম্যাচে স্প্যানিশরা একবারও তাদের জাল ভেদ করতে পারেনি। তাদের গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনো দেয়াল হয়ে দাঁড়ান স্প্যানিশদের সামনে। আর শেষ আটে পর্তুগালের মতো দলকে হারিয়ে দিয়েছে তারা। তিন ভাগের বেশি সময় বল দখলে রেখেও মরক্কোর গোলমুখ খুলতে পারেনি পর্তুগিজরা। ফলে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরা। অন্যদিকে রূপকথার জন্ম দিয়ে মাঠ ছাড়লেন হাকিম জিয়াচরা।

শুধু আফ্রিকান হিসেবেই নয়, আরব দেশগুলোর মধ্যেও বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠা প্রথম দল মরক্কো। এর আগে এই মরক্কো ১৯৮৬ বিশ্বকাপে, সৌদি আরব ১৯৯৪ বিশ্বকাপে এবং আলজেরিয়া ২০১৪ বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় উঠেছিল; যা এতদিন আরবদের সেরা সাফল্য ছিল। আর মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সেরা সাফল্য ছিল তুরস্কের। ২০০২ জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল তারা। সেমিতে ব্রাজিলের কাছে ০-১ গোলে হারের পর স্থান নির্ধারনী ম্যাচে কোরিয়ানদের হারিয়ে তৃতীয় হয়েছিল তুর্কিরা। এবার তাদের সেই কীর্তি স্পর্শ করল মরক্কো।

এবার আরবের প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজন করেই ইতিহাস গড়ে কাতার। কিন্তু মাঠে তারা কোনো সাফল্য পায়নি। আয়োজকরা না পেলেও এবার প্ররথম বিপ্লব ঘটায় সৌদি আরব। গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই তারা হারিয়ে দেয় আসরের অন্যতম ফেভারিট আর্জেন্টিনাকে। এছাড়া ডেনমার্কের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে আফ্রিকার আরেক আরব দেশ তিউনিসিয়া। এই দলগুলো অবশ্য আর কোনো সাফল্য পায়নি। কিন্তু মরক্কো টিকে আছে বীরদর্পে।

সিজদায় লুটিয়ে ঐতিহাসিক বিজয় উদযাপন মরক্কোর

কাতার বিশ্বকাপ স্বপ্নের মতোই কাটছে মরক্কোর। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা দলটি পর্তুগালের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছে।

জিতলে সেমিফাইনাল নিশ্চিত। হারলে বিদায়। এমন কঠিন সমীকরণের কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে ১-০ হারিয়ে সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করেছে মরক্কো।

এ বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে তাই খেলা শেষেই একযোগে সবাই মাঠের ভেতরেই লুটিয়ে পড়েন সিজদায়।অবনত মস্তকে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আফ্রিকার মুসলিম দেশ মরক্কোর খেলোয়াড়রা।

এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত প্রতিপক্ষের কোনো ফুটবলার তাদের বিপক্ষে গোল করতে পারেননি। একমাত্র গোলটি তারা খেয়েছে আত্মঘাতী গোল হিসবে। এখন পর্যন্ত কোন দলই তাদেরকে হারাতে পারেনি।

তাই বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচ শেষে সিজদার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান মরক্কোর খেলোয়াড়রা। এবার ইতিহাস গড়ার ম্যাচে পর্তুগালকে হারিয়েও একইভাবে কৃতজ্ঞতা জানালেন তারা।

শনিবার দোহার আল থুমামা স্টেডিয়ামে খেলার ৪২তম মিনিটে দুর্দান্ত এক হেডে পর্তুগালের জালে বল জড়িয়ে দেন মরক্কোর ইউসুফ এন-নেসিরি।

খেলার শুরুর একাদশে মাঠে নামনো হয়নি পর্তুগালের সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে। খেলার ৫২ মিনিটে রুবেন নেভাসের জায়গায় মাঠে নামানো হয় রোনালদোকে।

৬৫ মিনিটে আবারো গোলের সুযোগ পায় পর্তুগাল। কিন্তু ব্রুনো ফার্নান্দেজের দুর্দান্ত শট গোলবারের সামান্য উপর দিয়ে চলে যায়। হতাশায় মুষড়ে পড়েন ব্রুনো।

৮৩ মিনিটে মরক্কোকে নিশ্চিত গোল খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন মরক্কোর গোলরক্ষক আগের ম্যাচের নাত্যক বুনু। ডি বক্সের সামান্য ভেতরে থেকে হোয়াও ফেলিক্স বা পায়ের দুর্দান্ত বাকানো শট নিলে ডান দিকে ঝাপিয়ে পড়ে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন বুনু।

৯০ মিনিটে ডিবক্সের ভেতর থেকে রোনালদোর ডান পায়ের জোড়ালো শট রুখে দেন বুনু। ৯২ মিনিটে মরক্কোর চেদিরা দ্বিতীয় হলুদ কার্ড পেলে ১০ জনের দলে পরিণত হয় আফ্রিকান দলটি।

৯৫ মিনিটে গোলের সুবর্ণ সুযোগ মিস করেন মরক্কোর আবুখলিল। পর্তুগিজ গোলরক্ষককে একা পেয়েও গোল দিতে পারেননি তিনি। ৯৭ মিনিটে পেপের দুর্দান্ত হেড গোলবার ঘেষে চলে গেলে গোলবঞ্চিত হয় পর্তুগাল।

ম্যাচের একদম শেষ দিকে আরো দুটি গোলের সুযোগ তৈরি করলেও গোল দিতে পারেনি পর্তুগাল। ফলে বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতেই বিদায় নিল পর্তুগাল। আর ইতিহাস গড়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠলো মরক্কো।

Pin It