বাজারে মূল্যস্ফীতির হার কমছে। বাজারে পূণ্যমূল্যের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার কথা। কিন্তু সরকারি রিপোর্টে এ হার কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমতে থাকে। গত নভেম্বরে এ হার কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিবিএসের হিসাবেই ওই চার মাস বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। আবার তাদের হিসাবেই ওই চার মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার যখন লাগামহীনভাবে ঋণ নিচ্ছে, নিত্যপণ্য বিশেষ করে চাল, ডাল, আটাসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়ছে, টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, আমদানি পণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি সংকটও রয়েছে-তখন মূল্যস্ফীতির হার কমতে পারে না। বাড়ারই কথা।
কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে, এতে চাহিদা কমেছে। দরিদ্রদের জন্য সরকার বিশেষ খাদ্য কর্মসূচি চালু করেছে, এছাড়া স্বল্পআয়ের মানুষের মধ্যে কম দামে পণ্যের জোগান বাড়ানো হয়েছে। বাজারে শীতের সবজি আসায় দামও কমেছে। আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে এ খাতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এতে আমদানি কমেছে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতির হার অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে বেশি প্রভাব পড়ে পণ্য ও সেবার দাম বাড়লে। মুদ্রার মান কমে গেলে। সব খাতেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার উপসর্গ রয়েছে। বাংলাদেশে মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির হার কমানো যায় না। কারণ মুদ্রানীতির উপকরণগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে টাকার প্রবাহে লাগাম টানতে, কিন্তু বাস্তবে তা বেড়ে যাচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দরিদ্র মানুষের জন্য কম দামে যেসব পণ্য দেওয়া হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এটি মূল্যস্ফীতিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলার কথা নয়।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণের জন্য ১২ খাতের ৪৭টি পণ্য নিজস্ব উৎসের মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর (বেশি চাহিদার ভিত্তিতে গুরুত্ব) দেওয়া আছে খাদ্যপণ্যে। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল ও আটায় বেশি ভর রয়েছে। সব মিলে ৪৭টি পণ্যের মধ্যে ২৭টি পণ্যের দাম বেড়েছে। সামান্য কমেছে ১৭টি পণ্যের দাম। এর মধ্যে সবজি, ভোজ্যতেল রয়েছে। ৩টি পণ্যের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত।
এর বাইরেও মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণে আরও উপকরণ রয়েছে। সেগুলোতেও নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে সেবাসহ অন্যান্য খাত। এসব খাতেও ব্যয় বেড়েছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চালের মধ্যে নাজিরশাইলের প্রতি কেজির দাম গত আগস্টে ছিল সাড়ে ৭৫ টাকা। নভেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৮২ টাকা ৫১ পয়সা। পাইজামের দাম একই সময়ের ব্যবধানে প্রতি কেজি ৬৪ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৪ টাকা ৬৭ পয়সা। ইরি চালের দামের কেজি ৫৬ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বেড়ে ৫৮ টাকা ৯৪ পয়সা হয়েছে। একই সময়ে আটার কেজি ৫৫ থেকে বেড়ে ৫৯ টাকা ১১ পয়সা হয়েছে। মসুর ডাল ১৩০ থেকে বেড়ে ১৩৬ টাকা ৫৭ পয়সা কেজি বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি চিনির দাম ৯৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে ১০৩ টাকা ৪৬ পয়সা, গরুর মাংস ৭০০ থেকে বেড়ে ৭১৮ টাকা ৭৭ পয়সায় বিক্রি হয়। ফার্মের ডিমের হালি ৪৮ টাকা ৬৭ পয়সা থেকে কমে ৪৩ টাকা ১৭ পয়সায় বিক্রি হয়। সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৯২ থেকে কমে ১৯০ টাকা হয়েছে। আলুর কেজি ৩০ থেকে কমে ২৮ টাকা ৭০ পয়সা হয়েছে। একই সময়ে পেঁয়াজের কেজি ৫০ থেকে বেড়ে ৫১ টাকা। লবণ প্রতি কেজি ৩৫ থেকে বেড়ে ৩৮ টাকা ৪০ পয়সা দরে বিক্রি হয়।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ভোক্তারা বেশি ব্যবহার করেন এমন সব পণ্যের দাম বেড়েছে। তেল ও ডিমের দাম কমলেও পরিমাণে খুবই কম। তবে সবজির দাম বেশ কিছুটা কমেছে। তবে অন্যান্য পণ্যের দাম কমলেও সেগুলোর ব্যবহার কম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছিল। এর মধ্যে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছিল ৯৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে দশমিক ৮৫ শতাংশ। অথচ এক বছর আগে গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ।
গত ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের সরবরাহ কমে গিয়ে দাম বাড়তে শুরু করে। মার্চে তা আরও বেড়ে যায়। এতে মূল্যস্ফীতির হারও বাড়তে থাকে। বেশি দামে পণ্য আমদানি হলে দেশে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে এবং ডলারের সংকট মোকাবিলায় এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমিত আকারে এলসি মার্জিন আরোপ করে। জুলাইয়ের শুরুতে তা আরও বাড়িয়ে বিলাসী পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে বাড়ানো হয় নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জুলাই থেকে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের ঘোষণা দেয়। বাড়ানো হয় নীতিনির্ধারণী সুদের হার। একই সঙ্গে বাজারে বাড়ানো হয় তদারকি। এসব পদক্ষেপের ফলে সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতির হার কমতে থাকে। অক্টোবর মাসেও কমে। নভেম্বরে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ হয়। এর মধ্যে খাদ্যে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
সূত্র জানায়, গত জুলাইয়ের শেষে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯৪ টাকা। নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ টাকায়। ওই চার মাসের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ৪ টাকা। ওই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। ডলারের দাম ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কেনায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতিতেও চাপ বেড়েছে। এছাড়া পরিসংখ্যান ব্যুরোর পণ্যমূল্যের যেসব তথ্য দিয়েছে এর মধ্যে কিছু পণ্যের দাম বাজারে এর চেয়ে বেশি।
দেশের অর্থনীতিবিদরা বিবিএসের তথ্যকে আমলে নেওয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রেই আপত্তি করেন। তারা এ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার দাবি করেছেন বিভিন্ন সেমিনারে। সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারকও বিবিএসের তথ্য নিয়ে আপত্তি করেছেন। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকেও তাদের তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি আধুনিকায়নের কথা বলা হয়েছে।