আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মেয়াদ ২৩ এপ্রিল শেষ হচ্ছে।
এর আগেই ক্ষমতাসীনদের বেছে নিতে হবে তার পরবর্তী উত্তরাধিকারীকে। কে হচ্ছেন নতুন রাষ্ট্রপতি-এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নানারকম আলাপ-আলোচনা ও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। আসছে নানা মত। রাজনীতির অন্দরমহলেও এই পদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির নাম আলোচিত হচ্ছে। তবে আলাপ-আলোচনা যাই থাকুক না কেন, দিন শেষে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
বঙ্গভবনের পরবর্তী বাসিন্দা কে হবেন-দিন শেষে তিনিই ঠিক করবেন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা বর্ষীয়ান ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ মো. আবদুল হামিদ বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রপতি, যিনি টানা দ্বিতীয় মেয়াদে এ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন তিনি। পাঁচ বছর মেয়াদপূর্তির পর ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
সংবিধান অনুযায়ী তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধানের ৫০(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘একাধিক্রমে হোক বা না হোক, দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।’
ফলে মো. আবদুল হামিদের রাষ্ট্রপতি হিসাবে চলতি মেয়াদই শেষ,আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পর্কে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ অবসানের কারণে উক্ত পদ শূন্য হইলে অথবা মেয়াদ শেষ হইলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের পূর্ববর্তী ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে শূন্যপদ পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’
সংবিধানের এই নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ২৩ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। এর আগেই ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন একজন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করতে হবে। আর এ কারণে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকারি দল।
আওয়ামী লীগের অনেকে মনে করেন, গত দুই মেয়াদে মো. আবদুল হামিদ যেভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, তা অভাবনীয় ও অসাধারণ। তার একজন বিকল্প খুঁজে পাওয়া দলটির জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। মো. আবদুল হামিদের একদিকে যেমন সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
অন্যদিকে প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসাবে ছিলেন সবার আছে আস্থাভাজন। দুই মেয়াদে তিনি নিজেকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে পেরেছিলেন এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকেও ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। আর এ কারণেই দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন-এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল, সবাই সজাগ দৃষ্টি রাখছেন।
আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন জায়গায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে নিয়ে। প্রথমত এর আগে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ স্পিকার ছিলেন। সেজন্য স্পিকার থেকে আওয়াামী লীগ রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করতে পারে-এরকম একটি ধারণা অনেকের মধ্যে কাজ করছে। আবার অনেকেই মনে করছেন, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী সভাপতি শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন।
যেহেতু আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং, তাই হয়তো ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকেই রাষ্ট্রপতি পদে ভাবা হতে পারে। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার চার মেয়াদের শাসনামলে নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীকে অধিষ্ঠিত করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি পদেও প্রথমবারের মতো কোনো নারীকে দেখা যেতে পারে।
সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতির এই আলোচনায় আরও বেশ কয়েকজনের নাম রাজনীতির অন্দর মহলে আলোচিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।
যদিও বেগম মতিয়া চৌধুরীকে জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসাবেও দেখা যেতে পারে চলতি অধিবেশনে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসাবে বেগম মতিয়া চৌধুরীকে দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে একজন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসাবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগ। তবে সেই অভিজ্ঞতা দলটির জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না।
এরপর ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দলটির সাধারণ সম্পাদক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ মো. জিল্লুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে। তার মৃত্যুর পর এ পদে অধিষ্ঠিত হন আরেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ মো. আবদুল হামিদ। আগামী দিনেও শেখ হাসিনা বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ব্যক্তিকেই বেছে নেবেন বঙ্গভবনের পরবর্তী বাসিন্দা হিসাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১ (১৯৯১ সালের ২৭ নম্বর আইন)-এর ৫ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য তফশিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি।
সূত্র বলছে, ফেব্রুয়ারিতেই বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকও ইতোমধ্যে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, নির্ধারিত সময়েই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। বুধবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে অধস্তন আদালতের বিচারকদের এক কর্মশালার উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘নির্ধারিত সময়েই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। যেহেতু তিনি (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) দুই টার্ম থেকেছেন, সংবিধান অনুসারে তিনি আর থাকতে পারবেন না। সেহেতু নতুন একজন নির্বাচিত হবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের যুগ্মসচিব ফরহাদ আহম্মাদ খান বৃহস্পতিবার বলেন, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষের দুই মাস আগেই সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনও সেই অনুযায়ী যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।
রাষ্ট্রপতি সরাসরি ভোটে নয়, সংসদ-সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তফশিল ঘোষণাসহ এ নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এই নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ-সদস্যরাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নির্বাচনি কর্মকর্তার সামনে নির্ধারিত ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রার্থীর নাম ও নিজের স্বাক্ষর দিয়ে তা জমা দিতে হবে।
এর মুড়ি অংশে স্বাক্ষর দিয়ে ভোটারদের ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে হবে। ভোট দেওয়ার পর সংসদ কক্ষে স্থাপিত এক বা একাধিক ব্যালট বাক্সে তা জমা দিতে হবে। প্রত্যেক সংসদ-সদস্যের একটি মাত্র ভোট থাকবে। সংসদ-সদস্য হিসাবে স্পিকারও এই নির্বাচনে ভোটার।
ভোটের দিন গ্যালারিসহ সংসদ কক্ষে প্রার্থী, ভোটার, ভোট নেওয়ায় সহায়তাকারী কর্মকর্তা ছাড়া সবার প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করবেন নির্বাচন কর্মকর্তা। ভোট শেষে নির্বাচন কমিশনার প্রকাশ্যে ভোট গণনা করবেন। সর্বাধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্তকে রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী ঘোষণা করা হবে। আর সমান ভোট পেলে প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে ফল নির্ধারণ করা হবে।
যদিও ১৯৯১ সালে পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সাতবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একবার রাষ্ট্রপতি পদে একাধিক প্রার্থী থাকায় সংসদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়।
আর ওই সময়কার বিরোধী দল ও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে। ওই নির্বাচনে আব্দুর রহমান বিশ্বাস জয়ী হন। এছাড়া প্রতিবার একক প্রার্থী হিসাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।