মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন লেখক, শিক্ষাবিদ ও কলামনিস্ট [২৩ ডিসেম্বর, ১৯৫২]। শিশু-কিশোরসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ও গণিতসহ তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক। তার লেখা ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘আমি তপু’, ‘দস্যি ক’জন’ ইত্যাদি পাঠকপ্রিয়তা পায়।
অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।
আমার শৈশব বাংলাদেশের অনেক জায়গায় কেটেছে আসলে। আমার বাবা [মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফয়জুর রহমান] পুলিশে চাকরি করতেন, শুরু হয়েছে সিলেট থেকে। সেখান থেকে গিয়েছি পঞ্চগড়, তারপর রাঙামাটি, সেখান থেকে বান্দরবান, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা, পিরোজপুর। ১৯৭১-এর পর ঢাকা। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে।
আপনার স্কুল জীবনের স্মৃতি বলবেন? কোন শিক্ষক আছেন কি যার কথা এখনও মনে পড়ে, বেঞ্চে বসে যার ক্লাশ করতে ইচ্ছা করে?
তখন তো ছোট্ট ছিলাম। এই ছোট্ট বাচ্চারা স্কুল পছন্দ করে না সেভাবে। আমিও যে স্কুল পছন্দ করতাম না তা নয়। তবে হ্যাঁ, এখনও মনে আছে বগুড়া জিলা স্কুলে কিছু শিক্ষক ছিলেন, খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন তারা।
আমার বাবার বই নিয়ে খুব আগ্রহ ছিলো। বাসাভর্তি অনেক বই ছিলো। আমার জন্মের পর থেকে বলতে গেলে শুধু আমি নই, আমার ভাই-বোন সবাই বইয়ের জগতে বসবাস করেছি। শৈশব পুরোটা বই পড়ে পড়ে কেটেছে।
এবারের বইমেলায় ‘অনন্যা’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে আপনার বই ‘স্মার্ট ফোন নাকি স্মার্ট বাচ্চা’। সেখানে পিকলু নামে একটি চরিত্র আছে যাকে বলা হচ্ছে ‘স্মার্ট বাচ্চা’। সে বাংলায় ‘বিবমিষা’ বানান করতে পারে, ইংরেজিতে ‘নিউমোনিয়া’ বানান করতে পারে। এখনকার শিশু-কিশোররা তো প্রযুক্তিনির্ভর। এসব গেজেট শিশুদের মননশীল করতে পারছে কিনা?
ছোট্ট বাচ্চাদের মানুষ হিসেবে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, যত্ন সহকারে কীভাবে পড়ানো যায় তা-ই আছে এ বইয়ে। সারা পৃথিবীতে অটিস্টিক বাচ্চা অনেক বেশি বেড়েছে, বাচ্চাদের স্পিচ ডিলে হচ্ছে, অ্যাটেনশন স্প্যান কমে যাচ্ছে। সবগুলো হচ্ছে এই সমস্ত যন্ত্রের জন্য। শিশুদের জীবন্ত মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত, যন্ত্রপাতির সঙ্গে নয়। একটা যন্ত্রের সঙ্গে বড় হওয়ার জন্য তাদের জন্ম হয়নি।
মেলায় ‘করাতমাছ’ নামে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে আপনার, ‘তাম্রলিপি’ থেকে। এর উৎসর্গে আপনি লিখেছেন, “যারা বনের পশু ভালোবাসে, পানির মাছ ভালোবাসে এবং আকাশের পাখি ভালোবাসে- তাদের জন্য”। এখন তো শহর আর গ্রামেও খেলার মাঠ, পার্ক ও উদ্যান কমে যাচ্ছে। শিশুরা কীভাবে পশু, গাছ, পাখি ও আকাশ ভালোবাসতে শিখবে?
বাবা-মায়ের দায়িত্ব প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করানোর। ওদের নিয়ে যেতে হবে মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে, তাই না! আমাদের বাংলাদেশ তো ঘনবসতিপূর্ণ। তবে এখানে সুন্দরবন আছে, সমুদ্রবন্দর আছে। আর আকাশ তো সবসময় দেখা যায় উপর দিকে তাকালে! তো বাবা-মায়ের দায়িত্ব ওইসব এলাকায় বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। একটা ছোট্ট বাচ্চা প্রকৃতির সঙ্গে বড় হতেই হবে। যদি তা না হয় তাহলে বুঝতে হবে বাবা-মায়েরা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না।
পিথাগোরাসের একটি কথা আছে, ‘শিশুদের সুশিক্ষা দাও, তাহলে আর বড়দের শাসন করার প্রয়োজন পড়বে না’। দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু, কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষখাতে ব্যয় করার সুপারিশ আছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো)। আনফরচুনেটলি আমাদের দেশে শিক্ষাখাতকে আমলে নেওয়া হয় না। এ খাতে ব্যয় কমতে কমতে এখন ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এতো কম বরাদ্দে তো লেখাপড়া হওয়ার কথা নয়। শিক্ষাখাতে এতো কম খরচ মনে হয় না পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে। তারপরও যেটুকু হচ্ছে আমি মনে করি শিক্ষাখাত ভালো আছে। এ বিষয়ে আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, কথা বলেছি। কিন্তু সরকার এটাকে কখনও গুরুত্ব সহকারে দেখেনি। তো ওভাবে রয়ে গেছে।
আপনার লেখালেখিতে আগ্রহের বড় একটা জায়গা ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তবাক এবং মুক্তমনের কথা। কেবল পাঠ্যপুস্তকের সূচি সংযোজন-বিয়োজন কিংবা সিলেবাস প্রণয়ন করে কি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শিশু-কিশোরদের দায়বদ্ধ করা যাবে?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটা অর্জনের ইতিহাস। কারণ আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এত বড় অর্জন আমার মনে হয় না ইতিহাসে আরেকটা আছে। একইসঙ্গে এটা বীরত্বের ইতিহাস, যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তারা একেবারেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তারপরও তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এটা ত্যাগের ইতিহাস। এতো মানুষ মারা গিয়েছিল যুদ্ধের সময় যে প্রত্যেকটা পরিবার থেকে কেউ না কেউ হারিয়ে গিয়েছিল। এই ইতিহাস যদি শিশু-কিশোররা জানে তাহলে তারা নিজের দেশকে ভালোবাসবে। ওরা যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা জানে, সেজন্য আমি নিজের মতো করে চেষ্টা করি, মুক্তিযুদ্ধের উপর বই লিখি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি যখন যেভাবে পারি। মাঝখানে একটা দুঃসময় এসেছিলো। সেসময় মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরা মন্ত্রী হয়েছিলো। আমরা সেই দুঃসময়টা পার করে এসেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি, এখন মনে হয় যে আমরা স্বাধীন। একটু সতর্ক থাকতে হবে যেন আবার কখনও এই ধরণের বিপদে না পড়ি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলে না যাই।
শিশু-কিশোরদের জীবনের নানা লক্ষ্য থাকে- কেউ চিকিৎসক হবে, প্রকৌশলী হবে, কেউ বিজ্ঞানী হবে ইত্যাদি। কিন্তু কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে- এমনটা শোনা যায় না। বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হওয়ার ইচ্ছে কেউ পোষণ করে না। কেন করে না?
দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কেবল একজন প্রধানমন্ত্রী হয়। এটা তো জানা কথা- প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি মনে করি অনেক শিশু আছে যারা মনে করে যে দেশকে ভালোবেসে দেশের কর্ণধার হবে। এটা অন্যায় ইচ্ছে নয়। কেউ বড় হয়ে রাজনীতি করে যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, কোন বাধা নেই তো! তবে বাবা-মা হিসেবে যদি সন্তানকে বলি ‘তোমাকে বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হতেই হবে’, এটা ঠিক নয়। তাকে বলতে হবে যে, তুমি বড় হয়ে রাজনীতি করে দেশের জন্য কাজ করবে, প্রধানমন্ত্রী না হয়েও দেশের জন্য কাজ করা যায়।
হেইজারের একটা কথা আছে এমন, ‘ফুল যখন ফুটতে পারে না আমরা তখন ফুল মেরামত করি না। ফুল যেখানে ফুটবে সেই পরিবেশটার যত্ন নিই’। শিশু-কিশোরদের বিকাশে আমাদের কেমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
একটা ছোট্ট বাচ্চার জীবন আমার মতো হবে না। তাদের চাপ দিয়ে লাভ নেই। সবাই ডাক্তার হবে না, সবাই ইঞ্জিনিয়ার হবে না। অনেকে শিল্পী হবে গান গাইবে, অনেকে ক্রিকেট খেলবে, অনেকে ফুটবল খেলবে। কাজেই শিশু যেটা ভালো পারে তাকে সেটা করতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের দেশে জিপিএ ফাইভের যে একটা চাপ আছে এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ওদের মতো করে ওরা বড় হোক। বাবা-মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুদের ভালো মানুষ হিসেবে বড় করা। তারপর শিশু তার নিজের জীবন নিজেই তৈরি করে নিতে পারবে।
দৈনন্দিন জীবনে এবং শিশুসাহিত্যে বাস্তব জগতের অনেক ঘটনা আমরা আড়াল করি। কিন্তু এই শিশুরাই যখন পরবর্তী জীবনে ঢোকে তখন তারা মিল খুঁজে পায় না। পৃথিবী যদি অসরলই হয়ে থাকে তাহলে আমরা কেন শিশুসাহিত্যে ‘সরলতা’ সাজিয়ে দেখাই?
শিশুরা সব বোঝে, ওরা চারপাশ দেখে। অনেক বাবা-মা মুখে বলে খুব ভালো, কিন্তু নিজেরা অসৎ। শিশুরা কিন্তু ঠিকই বোঝে, মনে কষ্ট পায়। শিশুরা ‘কিছুই বোঝে না’ এমনটা মনে করা ঠিক নয়, ওদেরও একটা বিবেক আছে, চোখ আছে, বুদ্ধিমত্তা আছে। ওদের স্বাভাবিকভাবে বড় হতে দেওয়া হোক। বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। প্রচুর বই পড়লেই ওরা জেনে যাবে সব, যা যা জানা দরকার। শিশুদের কখনও আন্ডারস্টিমেট যেন না করি। আমি শিশুদের বড় মানুষের মতো ট্রিট করি, আমি জানি তাদের চোখ খোলা আছে, সে সবকিছু দেখছে। আগে হোক পরে হোক সে এটা জেনে যাচ্ছে। শিশুদের ছোট্ট মানুষ ভাবার কোনো কারণ নেই, শিশুরাই বড়।
আপনার কোনো স্বপ্ন আছে যা পূরণ করতে চান…
নিজের জীবনটাই তো স্বপ্ন আসলে। শিশুদের পড়াশোনা যেন আনন্দময় হয়, কোন চাপ যেন না হয়। যেটা ভালো লাগে সে যেন সেটা করার সুযোগ পায়। স্বপ্ন দেখি দেশের অর্থনীতি আরও ভালো হবে, কোন বৈষম্য থাকবে না। ধনীর ছেলে আর গরিবের ছেলে যেন একই সুযোগ নিয়ে বড় হতে পারে- এটাই আমার স্বপ্ন।
অভিভাবকদের প্রতি আপনার বিশেষ কিছু বলার আছে কি?
একটা কথা বলার আছে। সবসময় বলি যে, আমরা খুব ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। প্রযুক্তি চলে এসেছে, কিন্তু এর ব্যবহার জানতে হবে। প্রযুক্তি যদি আমাকে দখল করে নেয়, যদি আমরা প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই, সেটা খুবই দুঃখের বিষয় হবে। আমি চাই সবাই বই পড়ুক, যারা বই পড়বে তারা এই প্রযুক্তির হাত থেকে মুক্ত হতে পারবে। অসংখ্য ভালো বই আছে, যদি তারা বই পড়ে তবে তারা সত্যিকার মানুষ হবে। আমার অনুরোধ, সবাই যেন নিয়ম করে বই পড়ে।