দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। তবে পাচারের পথ ও গন্তব্য পরিবর্তন হয়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত-বর্তমানে সবচেয়ে বেশি টাকা যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিখ্যাত শহর দুবাইয়ে। এরপরেই রয়েছে সিঙ্গাপুর। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং যুক্তরাজ্য রয়েছে এই তালিকায়।
তবে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটি থেকে গত ১ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশি আমানতকারীরা। বিষয়টি রহস্যজনক। পাচারের টাকা ফেরাতে চলতি অর্থবছর প্রণোদনা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু ১ টাকাও ফেরত আসেনি। এ অবস্থায় সুইস ব্যাংকের টাকার গন্তব্য দেশের স্বার্থেই জানা অতি জরুরি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই কারণে অর্থ পাচার বাড়ছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। যে কোনো সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে-এমন আশঙ্কায় টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেশে যেসব আইনকানুন রয়েছে, তা পাচার বন্ধ এবং আগে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এসব আইন কার্যকরের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। যারা রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ন্ত্রণে রেখে বা দখল করে অর্থ পাচার করছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে অর্থ পাচার করেছে, এমন শতাধিক ব্যক্তির নাম বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উলটো এরা রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, সুইস ব্যাংক এখন আর গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। টাকা পাচারের জন্য এটি কোনো আকর্ষণীয় জায়গা নয়। সুইস ব্যাংকে টাকা অনেক পুরোনো বিষয়। কারণ অর্থ পাচার এখন এত সহজ হয়েছে, চাইলে যে কোনো দেশে টাকা নিয়ে যাওয়া যায়। বতর্মানে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও হুন্ডি সিস্টেমে বিশ্বের অনেক দেশে আমাদের টাকা পাচার হচ্ছে।
তিনি বলেন বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেড় কোটির মতো প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। যারা দেশে যেসব রেমিট্যান্স পাঠাতে চান, সেগুলো হুন্ডির কাছে বিক্রি করে দেন। আর হুন্ডির লোকজন পাচারকারীদের নিজস্ব অ্যাকাউন্টে জমা করে দেন। সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গ্রহীতাদের পৌঁছে দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াসহ সব দেশে পৌঁছে যাচ্ছে। অর্থাৎ দেশ থেকে ব্যাপকভাবে পুঁজি পাচার হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। এগুলো হলো-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সে দেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট।
এসব রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের সিংহভাগই সুনির্দিষ্ট ১০ দেশে যায়। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কর কম এবং আইনের শাসন আছে, অপরাধীরা সেসব দেশকেই বেছে নিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-দুবাই, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং এবং থাইল্যান্ড। সাম্প্রতিক সময়ে পাচারের বড় অংশই দুবাইয়ে যাচ্ছে। বড় কয়েকটি গ্রুপ সেখানে অফিস খুলে টাকা পাচার করছে। এছাড়াও বড় অঙ্কের ঘুস লেনদেনের জন্য দুবাই নিরাপদ। পরিশোধ করতে হয় ডলারে। এসব লেনদেনে অনেককেই সহায়তা করছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ সুযোগ দিয়েছিল সরকার। কেউ ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে এনে বৈধ করতে পারবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ১ টাকাও ফেরত আসেনি। তবে এ ধরনের সুযোগের সমালোচনা করছে বিভিন্ন সংস্থা এবং অর্থনীতিবিদরা। বর্তমানে দেশে একজন নিয়মিত করদাতা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দেন। সে হিসাবে অর্থ পাচারকারীদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, টাকা পাচারের কারণ একাধিক। বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে ইতোমধ্যে টাকার মনে কমে গেছে। ফলে বিত্তবানদের অনেকে, বিদেশি মুদ্রায় নিজের সম্পদ রক্ষা করতে চাচ্ছেন। অপরদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তাদের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা জরুরি। এজন্য তারা টাকা বিদেশে রাখতে চাচ্ছেন। এক কথায় একদিকে অর্থনৈতিক দুর্বলতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-এ দুটি একসঙ্গে মিলিত হওয়াতে টাকা পাচার বাড়ছে।
তিনি বলেন-পাচার রোধে দেশে জ্ঞান, প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং আইনের অভাব আছে তা আমি মনে করি না। কিন্তু আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, সেটি নেই। কারণ যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তারা প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তির ভেতরেই অবস্থান করছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থ পাচার রোধে দেশে কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু দেশের ভেতরে স্থিতিশীল ও দায়বদ্ধ সরকার না থাকলে ওইসব ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। ফলে অন্য কোনো সামাজিক শক্তি, যদি ক্ষমতাবান হয়ে তাদের মোকাবিলা করতে না পারে, তাহলে প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসন দিয়ে এর সমাধান সম্ভব নয়। এমনকি নিয়ন্ত্রণে আনাটাও কষ্টকর। সে কারণে জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত কোথায় কী আছে-এগুলো ভালোভাবে সংগ্রহ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন-অর্থ পাচার নিয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি এবং ইমিগ্রেশনের কাছে তথ্য আছে। সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এই উদ্যোগের জন্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ থেকে প্রতিবছর যে টাকা পাচার হয়, এটি তার আংশিক চিত্র। পুরোটা চিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ মোট বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়। তার মতে, অর্থ পাচারের অনেক কারণ রয়েছে। আর এগুলো বন্ধের জন্য সরকারের সক্ষমতার অভাব হতে পারে। অথবা সরকারের সদিচ্ছা নেই।
তারমতে, পাচারকারীরা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা এ দেশে নিরাপদ বোধ করছে না। আর কারণ যাই হোক টাকা পাচার মোটেই শুভ লক্ষণ নয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের টাকার পুরোটাই দেশ থেকে পাচার হয়েছে, তা বলা যাবে না। তবে সিংহভাগই পাচার হয়েছে।
তিনি বলেন, শুধু সুইস ব্যাংক নয়, আরও অনেক দেশে টাকা পাচার হয়েছে। এরমধ্যে সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই টাকা গেছে। মোট ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে পাচার হয়েছে, এটা মোটামুটি বলা যায়। আর এই অর্থ পাচারের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। পরস্পর মিলেমিশেই এ কাজ করছে।
তিনি বলেন, পাচার বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। অপরদিকে পাচারের অর্থ ফেরত আনার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে রয়েছে। সেক্ষেত্রে যেভাবে সৎসাহস, দৃঢ়তা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার, সেখানে ঘাটতি আছে। ফলে টাকা ফেরত আনা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, সরকারের রাজস্ব দরকার। কিন্তু যাদের কাছ থেকে সহজে রাজস্ব আসবে, সেখানে জোর না দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর কর বাড়ানো হচ্ছে। যারা রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ন্ত্রণে রেখে বা দখল করে অর্থ পাচার করছে, তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতেই হবে। এই কারণে পাচার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
গত বছরে ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ১১২ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। গড়ে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, যে কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। অনেকেই এ দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করেন না। ফলে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। তার মতে, টাকা কারা পাচার করছে, সবার আগে তা চিহ্নিত করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ একবার বিদেশে টাকা গেলে তা ফেরত আনা খুব কঠিন। তার মতে, পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি বলেন, গত বছর পাচারকারীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ যারা পাচারের অর্থ ফেরত আনবে, তাদের মাত্র ৭ শতাংশ কর দিতে হবে। কিন্তু ১ টাকাও ফেরত আসেনি। এরপর অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো টাকা পাচার হয়নি। আসলে এটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, কী কারণে পাচার হয় এবং পাচারের পথগুলো বন্ধ করতে হবে।