আজ পবিত্র হজ। আরাফাতের ময়দানে থাকার দিন। সেলাইবিহীন শুভ্র কাপড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারা বিশ্ব থেকে সমবেত মুসলমানরা আজ সেখানে থাকবেন। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’ অর্থাৎ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার’-এ ধ্বনিতে আজ মুখর থাকবে আরাফাতের ময়দান। মিনায় মুসল্লিদের জড়ো হওয়ার মধ্য দিয়ে পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ৮ জিলহজ সোমবার সকাল থেকে মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও রোববার রাতেই হাজিরা মিনার তাঁবুতে পৌঁছে যান। হজযাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় সৌদি মুয়াল্লিমরা আগের রাত থেকেই হজযাত্রীদের তাঁবুর শহর মিনায় নেওয়া শুরু করেন। হজযাত্রীরা রোববার এশার পর থেকে মক্কার নিজ নিজ আবাসন থেকে ইহরাম বেঁধে মিনায় রওয়ানা হন।
সোমবার সারাদিন মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেছেন হাজিরা। তাঁবুর এই শহর মুখরিত হয়ে উঠেছিল ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে। সারা দিন ও রাত তারা মিনায় কাটান ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মশগুল ছিলেন জিকির ও তালবিয়াতে।
নামাজ আদায় করেন জামাতের সঙ্গে। আল্লাহর কাছে হাজিরা দিয়ে আত্মশুদ্ধি, মাগফিরাত ও রহমত চাইতে আসা এই মুসলমানরা আজ জড়ো হবেন আরাফাতের ময়দানে, যাকে হজের মূল অনুষ্ঠান বলা হয়।
করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে এ বছর রেকর্ডসংখ্যক মুসল্লি পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবে জড়ো হয়েছেন। এ বছর ২৫ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এবার রেকর্ডসংখ্যক মানুষ হজ পালন করবেন বলে জানিয়েছে সৌদি আরবের হজ ও উমরাহসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২২ হাজার ২২১ জন মুসল্লি হজ পালন করতে গেছেন।
দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার ভারত থেকে ২২ হাজার মানুষ হজ পালন করতে গেছেন। চার হাজার ৩১৪ জন নারী-পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হজ করতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে দিল্লি থেকে যাচ্ছেন ৩৯ জন।
সৌদি আরব যে তথ্য দিয়েছে, তাতে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ পৌঁছেছেন স্থলবন্দর দিয়ে। ছয় হাজারের বেশি মানুষ গেছেন সমুদ্রবন্দর দিয়ে, বাকিরা বিমানে।
করোনার সময় সীমিত পরিসরে হজ হয়েছিল। ২০২০ ও ২০২১ সালে বাইরের দেশ থেকে কাউকে হজ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ২০২২ সালে কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হয়। ১০ লাখ মানুষকে হজ পালনের অনুমতি দেওয়া হয়। এবার হজ হচ্ছে একেবারে স্বাভাবিক সময়ের মতো।
পবিত্র হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আর্থিকভাবে সামর্থ্য ও শারীরিকভাবে সক্ষম পুরুষ ও নারীর জন্য তা ফরজ। এবার যারা হজে এসেছেন তারা আজ সূর্যোদয়ের পর সমবেত হবেন মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বিদায় হজের স্মৃতিজড়িত আরাফাতের ময়দানে।
তিন দিকে পাহাড়ঘেরা প্রায় চার বর্গমাইল আয়তনের এ বিশাল সমতল মাঠের একপ্রান্তে জাবালে রহমত। অর্থাৎ রহমতের পাহাড়। ১৪শ বছরের বেশি সময় আগে এখানেই ইসলামের শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এ পাহাড়টিকে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলে থাকেন।
কথিত আছে, হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর এই আরাফাতে এসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের পর হজযাত্রীদের আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা থাকলেও সোমবার রাতেই নিয়ে যান মুয়াল্লিমের দায়িত্বশীলরা। সেখানে আগে পৌঁছে গেলে ফজর এবং জোহর-আসর আদায় করবেন আরাফাতের ময়দানে। সেখানে উপস্থিত না হলে হজ পূর্ণ হয় না।
তাই হজে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আজ আনা হবে এখানে। ইসলামী রীতি অনুযায়ী, জিলহজ মাসের নবম দিনটি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে ইবাদতে কাটানোই হলো হজ।
এখানে মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেবেন খতিব। এ বছর আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা দেবেন শায়খ ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ। একই সঙ্গে মসজিদে নামিরাতে নামাজও পড়াবেন তিনি।
এ বছর হজের আরবি খুতবা বাংলাসহ মোট ২০টির বেশি শোনা যাবে। বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য হজের খুতবার বাংলা অনুবাদ করবেন ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান মাক্কী, মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব। তারা সবাই মক্কার বিখ্যাত উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
ইসলামের বিধান অনুসারে, আজ সূর্যাস্তের পর আরাফাত থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় গিয়ে রাতযাপন ও পাথর সংগ্রহ করবেন হাজিরা। ১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে মুজদালিফা থেকে আবার মিনায় ফিরবেন হাজিরা।
মিনায় প্রত্যাবর্তনের পর হাজিদের ১০ জিলহজ পর্যায়ক্রমে তিনটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহর উদ্দেশে পশু কুরবানি ও মাথা মুণ্ডন করা। এরপর ১১ জিলহজ তিনটি শয়তানকে ২১টি পাথর মেরে হাজিরা তাওয়াফে জিয়ারত করবেন। তাওয়াফে জিয়ারতের মাধ্যমে হজের সব কটি ফরজ কাজ সম্পন্ন হবে।
তাওয়াফে জিয়ারত শেষ করে হাজিরা আবারও মিনায় চলে আসবেন এবং রাত্রি যাপন করবেন। ১২ জিলহজ তিনটি শয়তানকে প্রতীকী ২১টি পাথর নিক্ষেপ করে হাজিরা মক্কায় চলে আসবেন। সবশেষে কাবা শরিফকে বিদায়ি তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।
সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিনায় ৫৫০ শয্যার চারটি হাসপাতাল হজযাত্রীদের সেবায় প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া ১০০টি ছোট ও ৭৫টি বড় অ্যাম্বুলেন্স হাজিদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। এবার অসুস্থ মুসল্লিদের সেবায় রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহার হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি।
সৌদি মোয়াচ্ছাসা ১০ জিলহজ সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এবং ১১ থেকে ১৩ জিলহজ সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত পাথর মারতে না যেতে হাজিদের অনুরোধ করেছে।
এদিকে মক্কা সিটি করপোরেশনের ২৩ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী হাজিদের চলাচলের রাস্তা পরিষ্কার রাখবেন। মক্কার ৮টি হাসপাতাল, মিনা, মুজদালিফাও আরাফাতের ২৫টি মেডিকেল সেন্টার থেকে হাজিদের চিকিৎসাসেবা দেবে।
অ্যাম্বুলেন্সের বহরে ৫৭টি বড় ও ১২০টি মিনি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত। এসব অ্যাম্বুলেন্সে নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্র (আইসিইউ) ও চিকিৎসক রয়েছেন। সেবার জন্য পাঁচটি হাসপাতালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স অবতরণের জন্য পাঁচটি হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া জরুরি সেবার জন্য রেড ক্রিসেন্টের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে।