পশু কোরবানি করে অন্যের পাশে দাঁড়ানো আর আত্মশুদ্ধির শপথের মধ্যদিয়ে উদযাপিত হবে ঈদুল আজহা।
মাঝ আষাঢ়ে বৃষ্টি অনেকটা বিরামহীন, একদিন বাদেও আবহাওয়ার চিত্র বদলাবে না বলেই আভাস মিলছে; তার মধ্যেই কোরবানির ঈদ উদযাপন করবে বাংলাদেশের মুসলমানরা।
পশু জবাই করে অন্যের পাশে দাঁড়ানো আর আত্মশুদ্ধির শপথের মধ্যদিয়ে বৃহস্পতিবার উদযাপিত হবে ঈদুল আজহা।
কোরবানির ঈদে আনন্দ আয়োজনের সঙ্গে ত্যাগের আবাহন আর প্রত্যাশা ফুটে উঠে বেশিরভাগের মাঝে, ‘শহীদী ঈদ’ কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে লিখেছেন, ‘মনের পশুরে কর জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।’
মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ এই ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে কোরবানির পশু নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি সেরে রেখেছেন সামর্থ্যবানরা। ঈদের নামাজ পড়েই কোরবানি দেওয়া হবে পশু।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির মধ্যে আসা এবারের ঈদের বাড়তি দামের কারণে পছন্দের পশুর সঙ্গে বাজেটের মেলবন্ধন ঘটাতে হিমশিম খেয়েছেন অনেকে। এর বিপরীতে বিক্রি ও দাম কম হওয়ায় প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
দেশে চামড়া শিল্পের কাঁচামালের মূল জোগান এই ঈদ থেকে আসে বলে অর্থনীতিতেও বিশেষ গুরত্বপূর্ণ হয়ে আছে ঈদুল আজহা।
১০ দিন আগে আরবি জিলহজ মাসের চাঁদ দেখে ঈদ নিশ্চিত হওয়ার সুবাদে আগে থেকে গ্রামের বাড়ির পথ ধরেন রাজধানীর অনেক বাসিন্দা। ফলে চলতি পথে ভোগান্তির চিত্র আগের মতো অতটা পাওয়া যায়নি।
পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে ঈদের জন্য রাজধানী ছেড়ে এলাকায় গেছেন বেশিরভাগ রাজনীতিক। ঈদের পর নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে বিরোধীদল বিএনপি।
আম-কাঁঠালের মওসুমে আসা ঈদে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেইসবুক বন্ধুদের সবাইকে আমন্ত্রণ করেছেন তার নির্বাচনী এলাকা রাজশাহীর বাঘা-চারঘাট ঘুরে আসার।
নিজের আড়ানী এলাকার বাসায় বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া এবং আম পাড়া ও খাওয়ার সুযোগের পাশাপাশি আত্মীয়-বন্ধুদের জন্য অন্তত এক ঝুড়ি আম বিনামূল্যে দেওয়ার ঘোষণাও ফেইসবুকে দিয়েছেন তিনি।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ যে সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করছে, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বাণীতে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
তিনি বলেছেন, “করোনা মহামারীর অভিঘাত ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নিম্ন আয়ের মানুষ নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝে দিনাতিপাত করছে।
“সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে আমি দেশের বিত্তবান ও সচ্ছল ব্যক্তিবর্গকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। ত্যাগের শিক্ষা আমাদের ব্যক্তি জীবনে প্রতিফলিত হোক – এটাই সকলের কাম্য।”
পাশাপাশি সরকার নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করে এবং কোরবানির বর্জ্য অপসারণের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ বন্ধে সবাই সচেষ্ট থাকবে, এমন আশাও প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি।
ঈদুল আজহার মধ্য দিয়ে আসা শান্তি, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেশবাসীকে বাণীতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঈদের শুভেচ্ছা বাণীতে তিনি আরও বলেন, “ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক-এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক।”
ঈদুল আজহার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নিয়ে বৈষম্যহীন, সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান সরকারপ্রধান।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক ও সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথ ও সাধারণ সম্পাদক রমেন মণ্ডল ঈদে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, ঈদ ও ঈদে মিলাদুন্নবী, শারদীয় দুর্গোৎসব ও জন্মাষ্টমী, বড়দিন এবং বুদ্ধ পূর্ণিমা বাংলাদেশের জাতীয় ও সর্বজনীন উৎসব। এসব উৎসব সর্বস্তরের মানুষকে ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ করে। এটাই বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
ঈদ উপলক্ষে নানা আয়োজনে সেজেছে রাজধানীসহ দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলো। টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত হবে নানা অনুষ্ঠান। হাসপাতাল, কারাগার, শিশুসদনে দেওয়া হবে বিশেষ খাবার।
দেশবাসীকে ঈদের শুভ্চ্ছো জানালেন প্রধানমন্ত্রী
ঈদ জামাত কখন-কোথায়
দেশের প্রধান ঈদ জামাত হয় রাজধানীতে হাই কোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। এবার ঈদ জামাত শুরুর সময় নির্ধারণ হয়েছে সকাল সাড়ে ৭টা।
ঈদগাহের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বুধবার তদারক করেছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক।
নিরাপত্তার স্বার্থে এবার ঈদ জামাতে জায়নামাজ ও ছাতা ছাড়া আর কিছু সঙ্গে না নিয়ে যেতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ছাতাতে আপত্তি না থাকার কারণ বৃষ্টি। বুধবার সকাল থেকেই বৃষ্টিতে ভিজেছে রাজধানীসহ প্রায় গোটা দেশ।
বৃহস্পতিবার ঈদের দিনও আবহাওয়া এমন থাকবে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, “বৃষ্টিবিঘ্নিত সকাল পার করতে হতে পারে ঈদের দিন। হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে বিকালে বৃষ্টির মাত্রা কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।”
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি কম হলেও উত্তরাঞ্চলে বেশি হতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
যদি বৃষ্টি বেশি হয়, তবে প্রধান ঈদ জামাত জাতীয় ঈদগাহে না হয়ে হবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। তবে সময় পিছিয়ে যাবে আধা ঘণ্টা।
বায়তুল মোকাররমে এবারও পাঁচটি ঈদ জামাত হবে। সকাল ৭টায় হবে প্রথম জামাত। দ্বিতীয় জামাত হবে সকাল ৮টায়। তারপর পর্যায়ক্রমে সকাল ৯টা, ১০টা ও বেলা পৌনে ১১টায় আরও তিনটি জামাত হবে।
এবার কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানের ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৯টায়। দিনাজপুরের গোর এ শহীদ ময়দানে ঈদ জামাত হবে সাড়ে ৮টায়।
ঈদের জামাত কখন কোথায়
জায়নামাজ আর ছাতা বাদে অন্য কিছু জাতীয় ঈদগাহে নিতে বারণ
কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্খাপনা
ঈদের দিন বৃষ্টি হলে শুধু কোরবানির পশু জবাই নিয়েই ভোগান্তি হবে না, বর্জ্যও নগরবাসীর দুর্ভোগ তৈরি করবে।
ঈদের দিন বৃষ্টির কথা বিবেচনায় রেখে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সজাগ থাকতে পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরও।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে কোরবানির বর্জ্য সরানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
এবার কোরবানির পশুর বর্জ্য ৮ ঘণ্টার মধ্যে সরানোর ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তাতে সময় চাইছে ২৪ ঘণ্টা।
দুই সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে কোরবানির পশুর বর্জ্য এবং হাটের বর্জ্য অপসারণ করতে এরইমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সব কর্মীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
ঢাকার দুই সিটিতে এবার ১০টি করে ২০টি কোরবানির পশুর হাট বসেছে। ঢাকায় পাশাপাশি জবাই করা কোরবানির পশুর বর্জ্যও ঈদের দিন দুপুরের পর থেকে অপসারণ শুরু হবে।
কোরবানির ঈদের দিন যে ওয়ার্ড আগে বর্জ্যমুক্ত হবে সেই ওয়ার্ডকে পুরস্কৃত করার ঘোষণাও দিয়েছেন উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
কোরবানির প্রথম দিনেই বর্জ্য সরাতে চায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন
দ্রুত বর্জ্য অপসারণকারী ওয়ার্ড পাবে পুরস্কার: মেয়র আতিক
চামড়ার জন্য প্রস্তুত পোস্তা
বাংলাদেশে পশুর চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই পূরণ হয় কোরবানির পশু থেকে। সেকারণে এ সময়টাই চামড়া সংগ্রহের মূল মৌসুম।
সারাদেশের সংগৃহীত চামড়ার বড় অংশই আসে পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলোতে। সেখানে কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করার পর সেই চামড়া বিক্রি হয় ট্যানারিগুলোতে।
সেই কারণে পোস্তার আড়তগুলো ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। পুরনো চামড়া সরিয়ে ফেলা হয়েছে নতুন চামড়া রাখার জায়গা করতে।
এবার লবণের দাম বেশি বলে চামড়া সংরক্ষণের খরচ বেড়ে যাবে বলে আড়তদারদের শঙ্কা।
পোস্তার ব্যবসায়ী সোহরাওয়ার্দী অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, গত বার ৭৪ কেজি লবণ কিনেছিলাম এক হাজার থেকে ১০৫০ টাকায়। কিন্তু এবার সেই দাম ১ হাজার ৩০০ টাকায়ও উঠেছে। প্রতি বস্তায় প্রায় ৩০০ টাকার মতো বেড়েছে।
“এর সঙ্গে রয়েছে লবণ ট্রাকে ওঠানো ও ফের আড়ত ঘরে নামানোর খরচ। এই খরচ মিলিয়ে বস্তা প্রতি ৩০০ টাকা খরচ বাড়তি হচ্ছে এবার।”
লবণের সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও তা উৎপাদনে ব্যবহৃত পলিথিন ও পানি সেচে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়াসহ পরিবহনে বাড়তি ব্যয় যোগ হওয়ায় লবণের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঈদ সামনে রেখে পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার; ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৩ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪ টাকা বেড়েছে।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, গত বছর যা ৪০ থেকে ৪৪ টাকার মধ্যে ছিল।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া গত বছরের মতই প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।